আর বিপ্লব
ভারতীয় রুপি আজ ইতিহাসের সবচেয়ে নিচু স্তরে পৌঁছে গেছে। ২৯ আগস্ট ২০২৫-এ এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপির মান ছিল ৮৮.২১ টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে এত বড় ধস আর ঘটেনি। বিষয়টি শুধু মুদ্রাবাজারের ওঠানামা নয়, এটি ভারতের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের এক গুরুতর সংকেত। এই পতনকে ঘিরে সাধারণ মানুষ, অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশেষজ্ঞ—সবাই একসঙ্গে উদ্বিগ্ন। রুপির দুর্বলতা মানে আমদানি খরচ বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি আরও চেপে বসবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবেন, আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বাড়বে চাপ।
রুপির পতনের পেছনে অনেকগুলি কারণ কাজ করছে। প্রথমত, বিশ্ববাজারে ডলার এখন অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতি কঠোর হওয়ায় ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির মুদ্রা দুর্বল হচ্ছে। ভারতও সেই প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মার্কিন প্রশাসন সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের উপর প্রায় ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। এর ফলে রপ্তানির সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি খাতের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা কমে যাবে, আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে রুপির উপর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন শুল্ক আরোপের কারণে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ০.৬০ থেকে ০.৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এই সামান্য শোনালেও জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটি বিশাল ক্ষতি। ভারত ইতিমধ্যেই কর্মসংস্থান সংকট, কৃষি সমস্যা এবং শিল্পে মন্থর গতির সঙ্গে লড়াই করছে। তার ওপর নতুন এই ধাক্কা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
শুধু শুল্ক নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাবও রুপির পতনের অন্যতম কারণ। ২০২৫ সালেই বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছেন ভারতের বাজার থেকে। তারা মূলধন সরিয়ে নিয়েছেন নিরাপদ বাজারে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। এর ফলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে। যখন বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যায়, তখন বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বেশি, জোগান কম—ফলে রুপির দর আরও নিচে নেমে যায়।
এই পরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI) হস্তক্ষেপ করেছে। RBI ডলার বিক্রি করে রুপিকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এবার তাদের পদক্ষেপ অতীতের মতো আক্রমণাত্মক নয়। অনেকেই বলছেন, RBI ইচ্ছে করেই কিছুটা অবমূল্যায়ন মেনে নিচ্ছে। এর পেছনে যুক্তি হলো, দুর্বল রুপি রপ্তানিকে কিছুটা সুবিধা দিতে পারে। বিদেশি ক্রেতারা সস্তায় ভারতীয় পণ্য কিনতে পারবেন। কিন্তু এই সুবিধার পাশাপাশি আমদানি খরচ বিপুলভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তেল, গ্যাস, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল—সবকিছুর দাম বাড়ছে। আর তার প্রভাব সরাসরি পড়ছে সাধারণ মানুষের উপর।
রুপির দুর্বলতা মানে হলো, প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার খরচ আরও বেড়ে যাওয়া। ভারত তার প্রয়োজনীয় তেলের প্রায় ৮৫ শতাংশ আমদানি করে। রুপির দর কমে গেলে আমদানিকৃত তেলের দাম বাড়ে, আর এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় ডিজেল ও পেট্রোলের মূল্য। পরিবহন খরচ বাড়ে, ফলে বাজারে সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বাড়তে থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারকে আরও বেশি খরচ বহন করতে হয়, নিম্নবিত্তের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়।
অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন, শুধু বহিরাগত কারণ নয়, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও রুপির পতনের জন্য দায়ী। ভারতে এখনও শিল্প খাত পর্যাপ্ত শক্তিশালী নয়, কৃষি খাতও নানা সমস্যায় জর্জরিত। সরকারি ব্যয়ের একটি বড় অংশ ভর্তুকিতে চলে যাচ্ছে, কিন্তু উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ তুলনামূলক কম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। আগামী নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক নীতি কতটা স্থিতিশীল থাকবে, সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সন্দেহ বাড়ছে।
বিশ্ববাজারেও অনিশ্চয়তা প্রবল। চীনের অর্থনৈতিক মন্থরতা, ইউরোপে মন্দার ছায়া, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও তেলের দামের অস্থিরতা—সব মিলিয়ে একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ভারতীয় রুপির উপর এ সব কিছুর প্রভাব পড়ছে সরাসরি। ডলার বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে ধরা হয়। তাই অনিশ্চিত সময়ে সবাই ডলার কেনার দিকে ঝুঁকছে। আর এটাই রুপিকে আরও নিচে ঠেলে দিচ্ছে।
তাহলে সামনে কী হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে রুপির পতন আরও গভীর হতে পারে। ৯০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এর থেকে বাঁচতে হলে ভারতের প্রয়োজন নীতি-সংগত শক্ত পদক্ষেপ। রপ্তানি খাতকে বাড়তি সহায়তা দেওয়া, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা, উৎপাদনশীল খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ—এসবই এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে শুধুমাত্র সরকার বা RBI-এর পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। ভারতের জন্য দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, যেখানে কৃষি, শিল্প, অবকাঠামো ও প্রযুক্তি একসঙ্গে উন্নত হবে। আমদানির উপর নির্ভরতা যতদিন বেশি থাকবে, ততদিন রুপিকে শক্তিশালী করা কঠিন। শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থাই রুপির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি।
রুপির এই পতন তাই একটি সতর্কবার্তা। এটি মনে করিয়ে দিচ্ছে, শুধু বর্তমানের সমস্যার সমাধান করলেই চলবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। মুদ্রার মান একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিফলন। রুপি যখন দুর্বল হয়, তখন তার মানে দেশের অর্থনীতিও নানা সমস্যায় জর্জরিত। আর তাই, এই সংকটকে যদি সতর্কবার্তা হিসেবে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করা যায়, তবেই ভারত আবার রুপিকে স্থিতিশীল করতে পারবে।
আজকের ৮৮.২১ টাকা শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি ভারতের জন্য এক বড় শিক্ষা। এই শিক্ষা হলো—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, রপ্তানিকে বাড়াতে হবে, আমদানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে, আর সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। এই মুহূর্তে ভারতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটাই।
সূত্র: Reuters, The Economic Times, Financial Times | গ্রাফিক্স: সংগৃহীত