আর বিপ্লব
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বামফ্রন্টের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসন ভেঙে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মানুষ “পরিবর্তন” এর ডাক দিয়েছিল। তৃণমূলের সেই আগমন ছিল আশার আলো—দুর্নীতি মুক্ত, সন্ত্রাসহীন, উন্নয়নমুখী এক নতুন রাজ্যের প্রতিশ্রুতি। প্রথম কয়েক বছরে একাধিক সামাজিক প্রকল্প, মহিলাদের জন্য কন্যাশ্রী, শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল বিতরণ, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো পদক্ষেপে সরকার প্রশংসা পায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই আশার গ্রাফ নামতে শুরু করে। আজকের পশ্চিমবঙ্গে, অনেকেই বিশ্বাস করেন, তৃণমূল ধীরে ধীরে সেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে যেটি একসময় বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল—দূর্নীতি, দম্ভ এবং জনগণ থেকে দূরে সরে যাওয়া।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ এসেছে দুর্নীতি নিয়ে। শারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, নারদ স্টিং অপারেশন, কয়লা ও গরুপাচার মামলা, এবং সর্বশেষ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি—প্রতিটি ঘটনা তৃণমূলের ভাবমূর্তিকে ধাক্কা দিয়েছে। “কাটমানি” শব্দটি সাধারণ মানুষের অভিধানে জায়গা করে নিয়েছে, যা নির্দেশ করে, সরকারি প্রকল্পে টাকা পেতে হলে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের অংশ দিতে হয়। এসব ঘটনায় শুধু বিরোধী দল নয়, সাধারণ মানুষেরও আস্থা কমেছে।
দলীয় সন্ত্রাস আরেকটি বড় কারণ। ভোট পরবর্তী সহিংসতা, বিরোধী কর্মীদের ওপর হামলা, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য হুমকি—এসব আচরণ রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করছে বলে অভিযোগ। যারা ২০১১ সালে পরিবর্তনের আশায় ভোট দিয়েছিলেন, তারা আজ অনেকেই মনে করেন, শাসক বদল হলেও রাজনীতির সহিংস সংস্কৃতি বদলায়নি।
কর্মসংস্থানের প্রশ্নে তৃণমূলের ব্যর্থতা বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে ক্ষুব্ধ করেছে। রাজ্যে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। নতুন বিনিয়োগ আনার চেষ্টা থাকলেও, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং আইনি অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কেলেঙ্কারি শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমালোচনা কম নয়। সরকারি হাসপাতালগুলির অব্যবস্থা, শয্যার অভাব, চিকিৎসক ও নার্স সংকট—এসব সমস্যা প্রকট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব এবং নিয়োগ দুর্নীতি একদিকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আস্থা নষ্ট করেছে, অন্যদিকে শিক্ষার মানকেও প্রভাবিত করেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি অনেকটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ না হওয়া, বা দলীয় কাঠামোতে বিকল্প নেতৃত্বের অনুপস্থিতি, ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। অতিনেতৃত্বকেন্দ্রিক এই কাঠামোতে ভুল সিদ্ধান্ত হলে তার সংশোধন তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় না।
প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বড় বড় প্রকল্পের বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে গুণগত মান নিয়ে বিতর্ক আছে। গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ বণ্টন, রাস্তা নির্মাণ বা আবাসন প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ স্থানীয়ভাবে ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বিরোধী শক্তিগুলির উত্থান তৃণমূলের জন্য ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে। বিজেপি ইতিমধ্যেই গ্রামীণ এলাকায় শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছে, আর বাম-কংগ্রেস জোট কিছু অঞ্চলে ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে। তৃণমূলবিরোধী ভোট যদি একত্রিত হয়, তাহলে নির্বাচনী অঙ্ক শাসক দলের বিপক্ষে যেতে পারে।
সবশেষে, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতার ক্লান্তি—যা রাজনৈতিক বিজ্ঞানে “অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি” নামে পরিচিত—তৃণমূলের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। ২০১১ থেকে ২০২৫—প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা যে কোনো দলের ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে নতুন বিকল্পের খোঁজ তীব্র হয়ে ওঠে। বামফ্রন্টের পতনের মতো, তৃণমূলের ক্ষেত্রেও মানুষ একসময় ভাবতে পারে, পরিবর্তনের সময় এসে গেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের গল্প তাই এক ধরনের চক্রের প্রতিচ্ছবি। যে চক্রে একটি দল মানুষের আশা নিয়ে আসে, প্রথমে কিছু সাফল্য দেয়, তারপর ধীরে ধীরে একই ভুলে জড়িয়ে পড়ে যা তার পূর্বসূরিদের পতন ডেকে এনেছিল। এই চক্র থেকে বেরোনোর উপায় একটাই—দলীয় শুদ্ধি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক পুনর্গঠন। তা না হলে, ইতিহাস দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা কোনো দলকেই চিরকাল ক্ষমতায় রাখে না।