আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে বামফ্রন্টের স্থান অনন্য। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে টানা ৩৪ বছরের শাসন ভারতের রাজনীতিতে এক বিরল নজির তৈরি করেছিল। ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং কৃষক-মজুর স্বার্থ রক্ষার নীতিতে তারা গ্রামীণ ভোটারদের আস্থা অর্জন করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান এবং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরাজয় বাম শিবিরের রাজনৈতিক যাত্রাপথে এক নাটকীয় মোড় আনে। আজ প্রশ্ন হলো—সাম্প্রতিক কার্যকলাপ কি বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএমকে তাদের পুরনো শক্তি ফিরিয়ে দিতে পারবে?
গত এক দশকে বামফ্রন্ট রাজ্যের রাজনৈতিক প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ২০১১-র পর পরবর্তী দুই বিধানসভা নির্বাচনে তারা তৃণমূল ও বিজেপির দ্বিমেরুকরণের মাঝে কার্যত চাপে পড়ে যায়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শূন্য আসন পাওয়ার ধাক্কা তাদের জন্য ছিল ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বড় পতনের চিত্র। তবে গত কয়েক বছরে বামফ্রন্ট বিশেষ করে সিপিআইএম কিছু কৌশলগত পরিবর্তন এনেছে। তারা ছাত্র-যুব আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আবার রাস্তায় ফিরেছে, বেকারত্ব, শিক্ষার বেসরকারিকরণ, এবং শিল্পহীনতা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রচার চালাচ্ছে। এই বিষয়গুলো তরুণ ভোটারের মধ্যে কিছুটা সাড়া ফেলেছে।
সাম্প্রতিক পৌরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিছু এলাকায় বামফ্রন্টের ভোটশেয়ার সামান্য হলেও বেড়েছে, বিশেষত কলকাতার ছাত্র-যুব ঘাঁটি এবং উত্তর ২৪ পরগনার কিছু অঞ্চলে। কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষ্ণনগর কলেজসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবার লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি, বিজেপি-বিরোধী ভোটের একাংশ যারা তৃণমূলের উপর আস্থা হারিয়েছে, তারা বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে—এটি বামদের জন্য একটি সম্ভাবনার জানালা খুলে দিয়েছে।
তবে চ্যালেঞ্জও বিশাল। প্রথমত, বামফ্রন্ট এখনও গ্রামীণ ভোটব্যাংকে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি ভাঙতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভাবমূর্তি থাকা সত্ত্বেও, তাদের শিল্পনীতি নিয়ে অতীতের বিতর্ক, বিশেষত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ইস্যু, অনেক ভোটারের মনে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে। তৃতীয়ত, সংগঠনগত দুর্বলতা—দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বহু পুরনো কর্মী অন্য দলে যোগ দিয়েছেন বা রাজনীতি থেকে সরে গেছেন।
বামফ্রন্টের পুনর্জাগরণের জন্য যে কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে, তার একটি বড় অংশ হলো সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনভিত্তি পুনর্গঠন। বেকার যুবকদের জন্য ‘চাকরি চাই’ আন্দোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিকাঠামোর উন্নয়নের দাবি নিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে দৃশ্যমান করেছে। কিন্তু রাজনীতিতে দৃশ্যমানতা আর ভোটে রূপান্তর—এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক অনেক।
জাতীয় রাজনীতির সমীকরণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বামফ্রন্টের মূল লড়াই তৃণমূল-বিজেপি বিরোধিতার মঞ্চে হলেও, কেন্দ্রীয় স্তরে বাম দলগুলি বর্তমানে তুলনামূলক দুর্বল, ফলে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে তারা জাতীয় রাজনৈতিক বাতাবরণের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। যদি বিজেপি-বিরোধী ভোটে তৃণমূলকে এড়িয়ে ভোটাররা বিকল্প খোঁজে, তবে বামেরা লাভবান হতে পারে; কিন্তু তৃণমূল এখনও রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে থাকলে বামদের জন্য জায়গা তৈরি কঠিন।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—বামফ্রন্ট কি নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্যকে নতুন প্রজন্মের ভাষায় রূপান্তর করতে পারবে? ৭০-৮০ দশকের জমি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য অতীতের ইতিহাস মাত্র। তাদের কাছে প্রাসঙ্গিক ইস্যু হলো চাকরি, প্রযুক্তি-ভিত্তিক শিল্প, নগর পরিকাঠামো, পরিবেশ রক্ষা। যদি সিপিআইএম এই সব ইস্যুকে সমসাময়িক ভাষা ও পরিকল্পনায় উপস্থাপন করতে পারে, তবে তাদের সম্ভাবনা বাড়বে।
সর্বোপরি, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দুইটি বিষয়ের উপর—সংগঠন পুনর্গঠন ও আস্থার পুনর্নির্মাণ। একসময় এই দল ছিল গরিব, শ্রমিক ও কৃষকের মুখপত্র; আজ তাদের সেই পরিচয়কে নতুন বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। যদি তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোয়, তবে আবারও তারা রাজ্যের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায়, বামফ্রন্টের পুনর্জাগরণ একটি দীর্ঘ ও কঠিন পথ—যেখানে প্রত্যেকটি পদক্ষেপকে রাজনৈতিকভাবে সঠিক ও সংগঠনগতভাবে দৃঢ় হতে হবে, নইলে এই যাত্রা অতীতের ছায়ার বাইরে যেতে পারবে না।