রাজীব সিকদার
সাল ইংরেজি ১৮৪৯। বিদ্যাসাগর তখন ২৯ বছরের শিক্ষিত যুবক। তিনি বুঝলেন যে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের সহিষ্ণুতা, দারিদ্র্য যন্ত্রণা, নানান সামাজিক নিগ্রহের পরিবেশের মধ্যে অবিচল উৎসাহ, অধ্যাবসায়, অক্লিস্ট পরিশ্রম ও বিজ্ঞানে অবদান এবং সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষিত, রীতিনীতি, আচার ও আনুষঙ্গিক তত্ত্বজ্ঞানের বিষয়টি পঠনপাঠনের অত্যন্ত প্রয়োজন। এবং সেটি বাংলা ভাষায় না হলে তা সকলের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তখনও কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, উইলিয়াম রস্কো, হ্যার্শেল, লিনিয়স, ডুবাল, জেসকিন্স, জোন্স প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে এদেশের মানুষের তেমন পরিচিতি ঘটেনি। ইংরেজিতে কিছু কিছু পাওয়া গেলেও তা সার্বজনীন শিক্ষার মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। তাই, তিনি এই বিজ্ঞানীদের জীবনী অনুবাদে লেগে পড়লেন। কিন্তু, যতটা করার কথা ছিলটা পুরোটা সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। ১৮৪৯ সালে বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রকাশিত ' জীবনচরিত ' গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি তা উল্লেখ করলেন এবং সাধ্য অনুযায়ী এই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের সামনে আনলেন। ঠিক এই পর্যায়েই ভারতের সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের নৈতিকতা, যুক্তি, মূল্যবোধ ও জ্ঞানের সাথে ভারতীয় মননের সংমিশ্রণ শুরু হয়। ধাপে ধাপে বিদ্যাসাগর একদিকে এদেশে ধর্মীয় কুপমুন্ডুক অন্যদিকে বিদেশী শাসকদের চাপানো ভাববাদী শিক্ষা প্রচলনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। ১৮৫৩ সালে তিনি বারাণসী সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল ব্যালেনণ্টাইনের প্রস্তাবিত সংস্কৃত পাঠ্যসূচির সমালোচনা করলেন এবং বার্কলের ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। ১৮৫৫ সালে প্রকাশ করলেন বর্ণপরিচয়। ধাপে ধাপে তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এদেশে মিলের লজিক, ইতিহাস, ভূগোল ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের প্রসার ঘটে।
মজার কথা যে বিদ্যাসাগর শিক্ষা অর্জনের প্রারম্ভে, এমনকি শিক্ষকতার সময়েও ভারতীয় সুপ্রাচীন দর্শন, ধর্মশাস্ত্র চর্চা করলেন সেই বিদ্যাসাগরই যাঁদের জীবনচরিত লিখলেন তাঁরা কেউ বাঙ্গালী বা ভারতীয় ছিলেন না। বিদ্যাসাগর সত্যযুগের পুনরাবির্ভাবের চিন্তা না করে, এবং ঐতিহ্য ও কাহিনী ভিত্তিক ভারতীয় মহাপুরুষদের জীবনীর কথা না ভেবে, এমন সব আধুনিক মানুষদের কথা লিখলেন, যাঁরা জ্ঞানে, কর্মে, সুনীতিনিষ্ঠায় অতুলনীয় ছিলেন। একই সাথে ওই বছরই তিনি মার্শম্যানের 'হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ' দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। তখনও বাংলা ভাষা ছিল দুর্বোধ্য এবং মদন মোহন তর্কালঙ্কার রচিত বাংলা বর্ণমালা ও ভাষা দ্বারা প্রভাবিত। যা খুবই কঠিন।
পরবর্তীতে ১৮৭৬ সালে তাঁরই অনুপ্রেরণায়, কনিষ্ঠ মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রচেষ্টায় যখন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্স ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে তখন বিদ্যাসাগর ছিল আর্থিক ও চিন্তাগত ক্ষেত্রে ছিলেন একজন গুরুত্ত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক যিনি নেপথ্যে বিজ্ঞান আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন । গোঁড়া ধর্ম শাস্ত্রের বিরুদ্ধে সমান্তরালে দাঁড় করালেন ভারতবর্ষের আধুনিক বিজ্ঞান চর্চাকে। বিদ্যাসাগর সৃষ্ট এই পথ আজও আমাদের পাথেয় হয়ে আছে।