যাঁরা সমাজ কি এর উত্তর ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তাঁরাই একমাত্র বুঝতে ও বোঝাতে পারেন সমাজের চিন্তার উৎস, বিকাশ ও ব্যক্তির গুনগত পরিবর্তন। একটা চিন্তা সমাজে যখন একত্রিত ভাবে চর্চা চলে তখন সেই চিন্তা ব্যক্তি বা সমাজ চেতনায় জায়গা করে নেয়। চিন্তার এই চর্চা কখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কখনো কর্মক্ষেত্রে মানুষের মতবিনিময় বা কখনো অসংগঠিত বা সংগঠিত রাজনৈতিক বা গণআন্দোলনের মাধ্যমে হতে পারে । যখন অন্ন , বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কিম্বা গণতান্ত্রিক অধিকার, নারীর অধিকার বা শোষণ, জুলুম, নিপীড়ন বন্ধ ইত্যাদি দাবি কোন সমাজে উত্থাপিত হয়, মানুষ দাবী আদায়ের লড়াইয়ে সামিল হয় তখনই মানুষ একে অন্যের জীবন যন্ত্রণাকে অনুভব করতে শেখে, শাসককে চিনতে শেখে, বুঝতে শেখে রাষ্ট্রকে।
দেখা যায়, শাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণ আন্দোলন মনের জানালা নয় , মনের আরো বৃহৎ দরজার পথ প্রস্তুত করে। শির তুলে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শেখায়। জনতার মুখের ভাষা যোগায়। আবেগের গভীরতাকে আরো আরো গভীর করে তোলে। হতভাগ্য মানুষগুলোকে আরো আরো কাছে টেনে নিতে শেখায়। তাঁদের নিজের সংগঠিত বার্তাকে গেঁথে দেয়। জনগণের মস্তিষ্কে সম্মিলিত ভাবে ভাবনার খোরাক যোগায়। মস্তিষ্কের সমস্ত জড়তাকে নাড়িয়ে দেয়, চিন্তার পথ প্রশস্ত করে। চলমান সমস্ত গোঁড়ামি ও ঐতিহ্যকে ভাঙতে শেখায়। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। চিন্তা-চেতনায়- অনুভূতিতে নতুন মানুষ তৈরি করে।
অতীতের লড়াইয়ের মহান আদর্শগুলোকে জনতার দরবারে আরো আরো নুতন নুতন ভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। সমগ্র মনন জগতের ছোট ছোট ঘর, ছোট ছোট সীমানা, বদ্ধমূল সংস্কার ও ব্যক্তিগত জড়তা সবকিছু ভেঙে মানবতার সীমাহীন প্রশস্ত আঙিনা তৈরি করে। সুচতুর বুদ্ধির সাথে গভীর মূল্যবোধকে যুক্ত করে দেয়। সমস্ত সংকীর্ণতাকে খুঁজে বার করে তাকে গভীর ভাবে অনুধাবন করতে শেখায়। অন্যদিকে চলমান আন্দোলনে বিচ্ছিন্ন জনতার মধ্যে বৃহৎ জ্ঞান সমুদ্র এবং অপার মমতার বেড়া জাল তৈরি হয় এবং তাঁদের এক সুতোয় বাঁধতে সাহায্য করে। ধারাবাহিক আন্দোলনের ময়দানেই জনতার মধ্যে উন্নত মূল্যবোধকে মনের গভীরে গেঁথে দেয়। সংগ্রামী জনতা নিজেই নিজেকে চিনতে শেখে, আত্মবিশ্বাসে আরো বলিয়ান হয়ে ওঠে। সমাজের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলে। সংগ্রাম এবং সৃষ্টি দুইই মননের অঙ্গ হয়ে ওঠে। যা কোনো সম্মিলিত আন্দোলন ছাড়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, গণআন্দোলনই মানবতা ধ্বংসের নেপথ্য শক্তিকে চিনতে সাহায্য করে। মুনাফাখোর ভোগবিলাসী মালিকের নেপথ্যে নীতিহীন দুরভিসন্ধিগুলোকে বাইরে বের করে সম্মিলিত জনতার সামনে প্রকাশ করে। সামগ্রিকভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যৌথ চেতনা, যৌথ জ্ঞান, যৌথ নীতি-নৈতিকতা- মূল্যবোধ, সামাজিক বন্ধন আরো আরো গভীর হয়। সমগ্র উদ্ভাবনী শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থা যৌথ রূপ পায়।
ক্ষমতাসীন সরকার কিম্বা রাষ্ট্রযন্ত্র তাই এই ভয়ে ভীত হয়ে সংগ্রামী জনতার লড়াইকে নানান ভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, আন্দোলনকে কালিমা লিপ্ত করার চেষ্টা করে, সুনির্দিষ্ট দাবি আদায় তৎক্ষনাৎ না হলে ' আন্দোলন ব্যর্থ ' বলে প্রচার চালায়। ভারতীয় কৃষকের সংগঠিত লড়াইয়ের চাপে বাধ্য হয়ে কেন্দ্র সরকারের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার আজকে এই শিক্ষাই দিচ্ছে। ডাক্তারি ছাত্রী অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবিতে আন্দোলন ও জনবিস্ফোরণ সরকার ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জনমত গড়ে দিয়েছে। এখানেই এই আন্দোলনের সামাজিক সফলতা। গণতন্ত্রের প্রথম যুগ থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে যত ছোটো বড় আন্দোলন হয়েছে সব আন্দোলনই বাস্তবে জনগণের চিন্তাকে, সমাজ বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। সম্প্রতি, মার্কিন দেশে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ২৭০০ শহরে ৭০ লক্ষ মানুষের অভ্যুত্থান বুঝিয়ে দিয়েছে সমাজের প্রান সত্বার প্রতিফলনকে। দেশে দেশে গড়ে ওঠা সব আন্দোলনই সমাজকে ভাবতে শিখিয়েছে, অনবরত ভাবতে শেখাচ্ছে। সংগঠিত বা অসংগঠিত লড়াই বা গণআন্দোলনের থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতালব্ধ এই জ্ঞানই আগামীর সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। এটাই আসলে বামপন্থা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা অবশিষ্ট গণতন্ত্র রক্ষার পথ, বিচ্ছিন্ন মানবতাকে এক সূত্রে গাঁথবার পথ ও বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠার রিহার্সাল।

