যোগমায়া আচার্য
১৫ আগস্ট—এই দিনটি ভারতের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। ১৯৪৭ সালের এই দিনে দীর্ঘ দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে ভারত স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখেছিল। অসংখ্য বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, নিরস্ত্র আন্দোলনকারী, শ্রমজীবী মানুষ এবং সাধারণ নাগরিকের ত্যাগ ও আত্মবলিদানের ফসল এই স্বাধীনতা। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং একটি জাতির আত্মমর্যাদার পুনর্জন্ম।
স্বাধীনতার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পণ্ডিত নেহরু প্রমুখ নেতাদের সাহস ও নেতৃত্ব, এবং অগণিত অজ্ঞাতনামা শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল এই পথ। কারাগারে বছরের পর বছর বন্দিত্ব, লাঠিচার্জ, নির্যাতন ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাঁদের মনোবল ভাঙেনি। তাঁদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি স্বাধীন ভারত, যেখানে প্রতিটি মানুষ সমান অধিকার ও সুযোগ পাবে।
আজ, স্বাধীনতার ৭৯তম বছরে দাঁড়িয়ে আমরা সেই স্বপ্নের অনেকটাই বাস্তবায়িত হতে দেখেছি, যদিও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে ভারত অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত শুধু নিজের উন্নয়নের পথ গড়ে তুলেনি, বরং বৈশ্বিক মঞ্চে সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করেছে।
তবে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ শুধু জাতীয় পতাকা উত্তোলন, মিছিল বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রতিদিনের জীবনে মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করার প্রতিশ্রুতি। দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করাও স্বাধীনতার রক্ষার অংশ। স্বাধীনতার অর্থ হলো প্রত্যেক নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিজের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার অধিকার, এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা।
আজকের দিনে আমাদের কর্তব্য হলো সেই ত্যাগ ও সংগ্রামকে স্মরণ রাখা, যা আমাদের এই স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাস জানানো জরুরি, যাতে তারা বুঝতে পারে স্বাধীনতা কোনও দান নয়—এটি অর্জিত, আর অর্জিত জিনিসকে রক্ষা করতে হয়।
১৫ আগস্ট তাই শুধু উদযাপনের দিন নয়, আত্মসমালোচনারও দিন। আমরা কতটা সঠিক পথে এগোচ্ছি, আমাদের গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, এবং আমরা কি সত্যিই প্রতিটি ভারতীয়কে সমান সুযোগ দিচ্ছি—এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি।
ভারত আজ নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে—আর্থিকভাবে শক্তিশালী, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, এবং সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত একটি জাতি হয়ে ওঠার। স্বাধীনতার এই ৭৯তম বর্ষে আসুন আমরা শপথ নিই—শুধু স্বাধীনতার ফল ভোগ করবো না, বরং তার মর্যাদা রক্ষা করবো, যাতে আগামী প্রজন্মও এই গর্বিত পতাকার নিচে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।