পাঠক মিত্র
স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরেও নেতাজি সম্পর্কে বিরূপ চর্চা সরকারিভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে উত্থাপিত হচ্ছে । প্রাক স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের শাসকের কাছে নেতাজিকে ব্রাত্য করে রাখার যে চক্রান্ত তারই ধারাবাহিকতার এটি তার প্রতিফলন । তাঁকে ব্রাত্য করে রাখাই ত তাঁর প্রতি বিরূপতা ছাড়া আর কিছু নয় । তাই তাঁর মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চক্রান্তের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি । প্রশাসনিক পদক্ষেপের চক্রান্তও স্পষ্ট হয়েছে । অথচ জনসাধারণের মনের মণিকোঠায় নেতাজির জায়গা চিরকালীন । আসলে যে আত্মত্যাগে সেনানায়ক থেকে জননায়ক হয়েছেন তা স্বাধীনতা পরবর্তী মানুষের মনেও তার ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ নেই । অথচ, দেশের মাটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর চিন্তা -ভাবনা ও প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন তদানীন্তন নানা মতাবলম্বী ক্ষমতাধর জনপ্রিয় সকল নেতা ও তাঁদের দল । তাঁদের দ্বিচারিতায় নেতাজি বারে বারে কোণঠাসা হয়েছেন । এখনও নেতাজি'র প্রতি দ্বিচারিতা চলছে । এখন যাঁরা দ্বিচারিতা করছেন তাঁরা কি তাঁদের (প্রাক্ স্বাধীনতা আমলে যাঁরা নেতাজির প্রতি দ্বিচারিতা করেছিলেন) উত্তরসূরী ?
নেতাজির বিরোধিতা যারা করেছেন, ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখে নিলে বোঝা যাবে, সেই সব মতাবলম্বীর আজকের উত্তরসূরিরা কে ?
কংগ্রেস সরকার নেতাজিকে যে সেভাবে স্মরণ করেনি সে তাদের প্রাক স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আচরণেই পরিষ্কার হয়ে আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ জঘন্যতম ষড়যন্ত্র করে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা করেছেন। হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি যাতে দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত না হতে পারেন তার জন্য স্বয়ং গান্ধীজী সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রের ভাষণে ছিল সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তিকে একত্রিত করার চেষ্টা। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সাথে ভূমি সংস্কার এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প ও কৃষির বিকাশ। যার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন গান্ধীজী। সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। কারন বিশ্বযুদ্ধে নানা ফ্রন্টে ব্রিটিশ লড়াই-এ ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে তারা সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে না। এই সুযোগকে তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের এই নীতি গান্ধীবাদী নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে নি। নেহেরুর কথায়- ব্রিটিশ যখন মরণপণ সংগ্রামে ব্যাপৃত তখন তার বিরুদ্ধে আইন অমান্যের প্রচার করা ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর ও অপমানজনক।' এ কথা বলে নেহেরু নিজের দেশকে, দেশবাসীকে অপমান করেছিলেন সেদিন। আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনের রাশ পুরোপুরি সুভাষচন্দ্রের হাতে চলে যাওয়ার ভয় কাজ করছিল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মনে। তাই ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি পদকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার উদ্যোগে পন্থ প্রস্তাব গৃহীত হয়। পন্থ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল তদানীন্তন কমিউনিস্ট ভাবধারার মানবেন্দ্র রায়ের গোষ্ঠী ও কংগ্রেস সোসালিস্টরাও । যে প্রস্তাবে বলা হয় গান্ধীজীর অনুমোদন ছাড়া কংগ্রেস সভাপতি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত করতে পারবে না। এই প্রস্তাবে কংগ্রেসে সংকট দেখা দিলে নেহেরু বলেন, এই সংকটের জন্য সুভাষচন্দ্রই দায়ী। নেতাজি তখন অসুস্থ, প্রচন্ড জ্বর। ব্যঙ্গ করে নেতারা বলছেন সুভাষের এ হল 'পলিটিকাল ফিভার'। কার্যত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অসুস্থ নেতাজিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। নেতাজির কথা থেকেই তা পরিষ্কার। তিনি বলেন,'গান্ধীজীর উপদেশ মতো যদি নিজের মনমতো কমিটি গঠন করতাম, তা না হত তার মনমতো না হতো তাঁর আস্থাভাজন। তাছাড়া আমার নিজের বিশ্বাসের প্রশ্নও এখানে জড়িত রয়েছে। তাই অনেক চিন্তা করে একান্ত সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আমার পদত্যাগপত্র আপনাদের কাছে উপস্থিত করলাম। ' ত্রিপুরী কংগ্রেসে এই পরাজয়ে সুভাষচন্দ্র বসু ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ' ত্রিপুরীতে এই পরাজয়... প্রবীণ বাঘা বাঘা বারো জন কংগ্রেসের নেতা, জওহরলাল নেহরু, সাত জন প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মহাত্মা গান্ধীর নাম, প্রভাব প্রতিপত্তি--এসবের বিরুদ্ধে রোগশয্যায় শায়িত একজন ব্যাক্তির লড়তে গিয়ে পরাজয়।....এই সংকটের সময় ব্যক্তিগতভাবে আামার এবং আমাদের আদর্শের যত ক্ষতি নেহেরু করেছিলেন আর কেউ তা করেনি।.. আমাদের পরাজয়ের আর একটা কারণ ছিল সি.এস.পি নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা,...আর কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। ' বামপন্থার নামে তদানীন্তন কমিউনিস্ট দলের চরিত্র সম্পর্কে নেতাজীর মন্তব্য,' বামপন্থীদের মতো কথা বলা আর দক্ষিণপন্থীদের মতো কাজ করা..সুবিধাবাদের প্রকৃষ্টতম উদদহরণ।' ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডের কথায়--'গান্ধী তার অসহযোগ অস্ত্রটি এই সময় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়, কংগ্রেস সভাপতি অর্থাত্ সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগে তিনি বাধ্য করলেন। ' শুধু তাই নয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বলে কংগ্রেস সুভাষচন্দ্রকে তিন বছরের সাসপেন্ড করেছিল। একে সুভাষচন্দ্র নিজেই 'কার্যত বহিষ্কার' বলে অভিহিত করলেন। তিনি বলেছেন, 'ক্ষমতা লিপ্সা কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে গ্রাস করেছে... সুযোগ এলে দক্ষিণপন্থী শাখা আপস করা থেকে বিরত থাকবে না। এটাই হল ক্ষমতা রাজনীতির জঘন্যতম রূপ। '
এমনকি সি পি আই নামধারী সাম্যবাদী দলটি তখন নেতাজীকে কোনোভাবে সহায়তা না করে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বকেই সাহায্য করেছে। নেতাজী তাই দুঃখ করে রজনীপাম দত্তকে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, 'আমাদের দেশে যাদের কমিউনিস্ট ভাবা হয়, তাদের কাজকর্ম দেখে আমার মনে হয়েছে যে, কমিউনিজম জাতীয় স্বাধীনতা বিরোধী।' এইধরনের কমিউনিস্টরা একদিন সুভাষ বোসের দেশপ্রেমকে অস্বীকার করে তাকে 'ফ্যাসীবাদের দালাল', কুইসলিং' বলেছিল। শুধু তাই নয়। তার আজাদ হিন্দ বাহিনী যখন এগিয়ে আসছে, তখন তথাকথিত নেতারা বলেছিলেন, ' সুভাষকে আমরা বুলেটের মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাব। ' সি পি আই নেতা রনদিভে বলেছিলেন, ' সুভাষ বোস এক বার্তায় অরাজকতা সৃষ্টি ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে ভূষিত করেছে।... জাপানী সাম্রাজ্যবাদের দালাল সুভাষ বোসকে কমিউনিস্ট পার্টি সেই জবাবই দেবে যা সত্ দেশপ্রেমিকরা বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহীদের দিয়ে থাকেন। ভারতের মাটিতে পা দিয়ে বোসের ভাড়াটে মুক্তি বাহিনী, চুরি ডাকাতির বাহিনী, লুটপাট ও ডাকাতির চেষ্টা চালালে তাদের উপর আমাদের রাগ ও ঘৃণা টের পাবে। ' নেতাজীর প্রশ্নাতীত দেশপ্রেমকে কুরুচি মন্তব্যে প্রকাশের মাধ্যমে এই কমিউনিস্ট নামধারী দলের নেতারা কি রুচির প্রমাণ রেখে গেলেন।
তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নেতাজী সম্পর্কিত সমস্ত খবর দেশবাসীর কাছে সঠিকভাবে পৌঁছতে পারে না। যদি সে চেষ্টা থাকতো তাহলে পার্লামেন্টে নেতাজীর পথিকৃৎ স্থান পেতে স্বাধীনতার পর ৩০ বছর লাগতো না।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বি জে পি ছিল না। ছিল হিন্দু মহাসভা ও আার এস এস। আজাদ হিন্দ বাহিনী যখন লড়ছে, বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তদানীন্তন আর এস এস প্রধান হেডগেওয়ারের কাছে অনুরোধ করেন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থানে নেতাজীকে সংঘ যেন সাহায্য করে। কিন্তু হেডগেওয়ার নেতাজীকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন। তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে সহায়তা করার জন্য বলেন,'বঙ্গদেশকে রক্ষা করিবার জন্য একটা গৃহ-বাহিনী গঠনের অধিকার আমাদের দেওয়া হউক। ' অর্থাত্ হিন্দু মহাসভার সমর্থন ব্রিটিশকে, নেতাজীকে নয়।
আজকে নেতাজিকে নিয়ে সমস্ত বিরূপতার বহিঃপ্রকাশ সেই রাজনৈতিক চর্চার ফসল যে চর্চা স্বাধীনতার ইতিহাসে নেতাজির বিরুদ্ধচারণ করেছিল।