নরেন্দ্রনাথ কুলে
সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট খুন হয়েছেন এমন তিনজনের নাম লেখ বলে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটু হইচই হয়েছে । ইতিহাসে এ দেশে ব্রিটিশের কাছে বিপ্লবীরা সন্ত্রাসবাদী বলে পরিচিত ছিলেন । কিন্তু আজকের স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পরে ইতিহাসে ব্রিটিশের ভাষাকে মান্যতা দেব কেন ? এ প্রশ্ন ইতিহাসবিদ থেকে বিশিষ্ট মানুষজন তাঁদের ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারেন । কিন্তু আমাদের প্রজন্মের কাছে আমাদের দেশের বিপ্লবীদের শুধু সন্ত্রাসবাদী বলে এখনও পাঠ্যসূচিতে পরিচয় দেওয়ার প্রবণতা কেন ? ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগ দিবসে সেই কথাই আবারো মনে করিয়ে দেয় ।
যত সময় গেছে । বিশেষ করে স্বাধীনতার পরে ক্ষুদিরামের সেই আত্মত্যাগের গরিমা যতটা বাড়ার কথা, তা না হয়ে ক্রমশঃ-তা ফিকে হয়েছে । স্বাধীনোত্তর বাঙালিকেও ক্ষুদিরামের নাম জঘন্যভাবে ব্যঙ্গাত্মক ইঙ্গিতে কথা বলতে শোনা যায় । আসলে ক্ষুদিরাম যে ধারায় স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন সেই ধারা ব্রিটিশের কাছে ভয়ঙ্কর ছিল । তাই ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষুদিরাম সন্ত্রাসবাদী ছিল । আর সেই কথাটাই তদানীন্তন ও স্বাধীনোত্তর কংগ্রেসের নেতারা তাই বিশ্বাস করেছেন । আসলে জনমানসে বিপ্লবীদের ডাকাত বলে একটা প্রচার ব্রিটিশরা চালাতো সবসময় । স্বদেশী ডাকাত বলেও প্রচার করা হয়েছে । এই প্রচারে তদানীন্তন আপোষকামী নেতারা নিজেদের বাঁচিয়ে চলেছেন । তাই ক্ষুদিরাম সন্ত্রাসবাদী বলে ব্রিটিশের কথাকেই মান্যতা দিয়েছে । স্বাধীনতার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদিরাম সন্ত্রাসবাদী বলে মজফফরপুরে তাঁর আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করার কথা দিয়েও শেষমুহূর্তে অসম্মত হয়েছেন । ক্ষুদিরামের প্রতি সেই অবমাননা এখনো বয়ে চলেছে । কখনো পাঠ্যসূচিতে । কখনো কোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমের পরিচয়ে । আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শাসক যদি নিজের মত করে রচনা করে তার ফল প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস মুছে যাওয়াটাই স্বাভাবিক । শাসক-যে ইতিহাস নিজের মত করে রচনা করেছে তা ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা থেকে জানা যায় । '১৯৫২ সালে যখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ' স্বাধীনতা ইতিহাস ' লেখার জন্য একটি সম্পাদক মন্ডলী নিযুক্ত করে আমাকে তার ডিরেক্টর পদে নিয়োগ করেন, তখনও আমি বিপ্লববাদের ইতিহাস লেখার জন্য জীবিত বিপ্লবী নায়কদের কাহিনী সংগ্রহ করার প্রস্তাব করি । কিন্তু কোন একটি বিশিষ্ট দলের নায়ক ছাড়া আর কারও কাহিনী সংগ্রহ করা হয় না । এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছিল যে, বিভিন্ন লোকের কাহিনী সংগ্রহ করলে তাতে গোলোযোগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে । আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, এইরূপ বিভিন্ন কাহিনী একত্র করলেই তা থেকে বিপ্লবের প্রকৃত ইতিহাস সংগ্রহ করা সম্ভব হবে । কিন্তু এ যুক্তি গ্রাহ্য হয়নি ।' আজও কিন্তু ইতিহাস নিয়ে সরকারের নির্দেশ প্রতিপালিত হচ্ছে । আজকের জাতীয় ও রাজ্য শিক্ষানীতি সেই নির্দেশের বাইরে নয় । এমনকি আজকের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনীতিকরণের বলিষ্ঠ শিকার ।
এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস ও বিপ্লবের ইতিহাস মুছে দেওয়ার জন্য যে প্রয়াস সেই ইতিহাসও প্রজন্মকে ভুলিয়ে দিতে চায় । অতীত থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের রূপরেখা যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাতে জানতে না পারে এটাই তার উদ্দেশ্য ।