পিয়া রায়
হিন্দু ধর্মে শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দেবাদিদেব মহাদেবের প্রিয় মাস হিসেবে বিবেচিত, আর তাই এই সময় ভক্তরা আরও নিবিড়ভাবে শিবপূজায় মগ্ন হন। শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবারে উপবাস পালন করার একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের দিক থেকেই নয়, বরং স্বাস্থ্য ও মনোবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এই উপবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রাবণ মাসে প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশের মাঝে এক ধরণের শুদ্ধতা বিরাজ করে। বর্ষাকাল শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মাটি, জল ও আকাশ যেন ধুয়ে-মুছে যায়। ঠিক তেমনি, মানুষের মনেও এই সময় এক ধরনের শুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা জাগে। উপবাস সেই শুদ্ধির অন্যতম উপায়। এ সময় ভক্তরা শুধুমাত্র নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন কিংবা নির্জলা উপবাস পালন করেন। উপবাস মানে শুধু আহার বন্ধ করা নয়, বরং ইন্দ্রিয় সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ঈশ্বরচিন্তায় মনোনিবেশ করাও এই রীতি অনুসরণের অন্তর্ভুক্ত।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, শ্রাবণ মাসের সোমবারে উপবাস করলে শিবের বিশেষ আশীর্বাদ লাভ হয়। এককালে দক্ষ প্রজাপতি তাঁর কন্যা সতীকে শিবের সঙ্গে বিবাহ দিতে না চাওয়ায় সতী দেহত্যাগ করেন, আর শিব তাণ্ডব নৃত্যে সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তখন দেবতারা শ্রাবণ মাসে তাঁর প্রশান্তির জন্য উপবাস করেন, এবং সেই পরম্পরাই আজও অব্যাহত। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, শ্রাবণের উপবাস মনোবাসনা পূর্ণ করে, পাপ মোচন করে এবং পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনে।
আধ্যাত্মিক গুরুত্ব ছাড়াও, এই উপবাসের শারীরিক উপকারিতাও বিস্তর। বছরের এই সময় আবহাওয়াগত পরিবর্তনের ফলে হজমের গণ্ডগোল ও সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে। উপবাস হজমতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয়, শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয় এবং ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া নিরামিষ ও হালকা খাদ্য গ্রহণ মানসিক প্রশান্তি ও ধ্যানের উপযোগী মনের পরিবেশ তৈরি করে। আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে, নিয়মিত অন্তর্বর্তী উপবাস শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়া উন্নত করে এবং দীর্ঘায়ুতে সাহায্য করে।
শ্রাবণের উপবাস কেবল ব্যক্তিগত সাধনার বিষয় নয়, এটি এক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সংহতির ক্ষেত্র। বহু মানুষ একসঙ্গে উপবাস পালন করেন, শিব মন্দিরে পূজায় অংশগ্রহণ করেন, কীর্তনে মিলিত হন—যা এক ধরনের সমবেত আধ্যাত্মিক শক্তির সৃষ্টি করে। জীবনের ব্যস্ততা, ক্লান্তি ও মানসিক দূষণের মাঝে এই উপবাস এক নির্জন বিশ্রাম, এক আত্মদর্শনের পথ।
অতএব, শ্রাবণের সোমবারের উপবাস শুধুমাত্র কোনও রীতির অনুসরণ নয়, এটি এক চর্চা—শরীর, মন ও আত্মাকে শুদ্ধ করে পরম সত্যের কাছে পৌঁছনোর এক সহজ ও নিঃস্বার্থ পথ। এই প্রাচীন আচার আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ একবিংশ শতাব্দীতেও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন কখনও কমে না।