যোগমায়া আচার্য
হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে শ্রাবণ মাস এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সময়। দেবাদিদেব মহাদেবের পূজার জন্য এই মাসকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়। বর্ষার মাঝপথে শ্রাবণ আসে এক নবজাগরণ নিয়ে—প্রকৃতির যেমন রূপান্তর ঘটে, তেমনই আধ্যাত্মিক জগতে ঘটে চেতনার উন্মোচন। এই মাসে ভক্তের হৃদয় যেন এক নিবেদিত পুষ্প হয়ে ওঠে, যা নিবেদন করা হয় শিবের চরণে।
পুরাণ মতে, শ্রাবণ মাসে দেবতারা সমুদ্র মন্থনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সেই সময় মহাবিষ ‘হালাহাল’ উঠে আসে। বিশ্বকে বাঁচাতে মহাদেব সেই বিষ পান করেন এবং তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়। সেই থেকে ‘নীলকণ্ঠ’ নামে অভিহিত হন তিনি। এই ঘটনাকে স্মরণ করে শ্রাবণ মাসজুড়ে ভক্তেরা জল, দুধ, বেলপাতা, ধুতুরা ও দত্তুরা নিবেদন করে মহাদেবের কণ্ঠ শীতল রাখার প্রতীকী প্রচেষ্টা চালায়।
এই মাসে সোমবারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ‘শ্রাবণ সোমবর’ পালনে ভক্তরা উপবাস করেন, মন্দিরে গিয়ে রুদ্রাভিষেক করেন এবং ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ মন্ত্রজপে মন নিমগ্ন করেন। এই রীতি বিশ্বাস করে যে, শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবার মহাদেবের কৃপা লাভের সর্বোত্তম সময়। অনেকেই মনে করেন, এই সময় অবিবাহিত নারীরা মহাদেবের কৃপায় কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গী লাভ করেন, আর দাম্পত্য জীবনে আসে শান্তি ও সমৃদ্ধি।
শ্রাবণ শুধু পূজার সময় নয়, আত্মসংশোধনেরও এক স্বর্ণ সময়। ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে ধ্যান, জপ, পাঠ ও নীরবতা চর্চার মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সংযোগ স্থাপনের প্রবল সুযোগ থাকে এই মাসে। অনেক সাধক ও গৃহস্থ এই সময় নিজেকে রুদ্রের আদলে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন—ত্যাগ, সংযম, ধৈর্য ও সহানুভূতির মাধ্যমে। কারণ মহাদেব কেবল ধ্বংসের দেবতা নন, তিনিই প্রকৃত আত্মজ্ঞান ও মুক্তির দিশারী।
শ্রাবণের প্রতিটি দিন যেন এক আধ্যাত্মিক উত্সব, যেখানে কণ্ঠে থাকে জপ, হাতে থাকে প্রসাদ আর হৃদয়ে থাকে শিবের চরণচিন্তা। গ্রামের মন্দির থেকে শহরের মণ্ডপ—সর্বত্র শোনা যায় ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি। গঙ্গাজল সংগ্রহ করে ‘কাঁवरিয়া’রা দীর্ঘ পথ হেঁটে শিবলিঙ্গে জল অর্ঘ্য দেন, যা এক অপার ভক্তির প্রকাশ। এই দেহজ ভ্রমণ যেন এক আত্মিক অভিযাত্রা হয়ে ওঠে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ মহাদেবের দিকে এক অগ্রসরতা।
শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু ঈশ্বর চিরন্তন। মহাদেব আমাদের শেখান সংযম, ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উপমা। তিনি নির্লিপ্ত, অথচ সর্বত্র জড়িত। তিনি অঘোর, কিন্তু আশ্রয়দাতা। তিনি ধ্বংসকারী, কিন্তু মুক্তির পথপ্রদর্শক। আর শ্রাবণ মাস সেই শুভ মুহূর্ত, যখন আমরা শিবের আশীর্বাদে নতুন করে নিজেকে চিনতে পারি।
শ্রাবণ মাস আসুক এক আধ্যাত্মিক জাগরণের বার্তা নিয়ে। মহাদেবের আশীর্বাদে ভরে উঠুক আমাদের মন, পরিবার ও সমাজ। কারণ শিব মানেই শান্তি, শিব মানেই চেতনার চূড়ান্ত শিখর।