পিয়া রায়
প্রতিদিনের জীবনে এমন কিছু শব্দ রয়েছে যা আমাদের কারও কারও কাছে অসহনীয়, অস্বস্তিকর বা যন্ত্রণাদায়ক মনে হতে পারে। কারও চিবানোর শব্দ, কারও নিঃশ্বাস, কলমের টিকটিক আওয়াজ বা আঙুল ঠোকার মতো সাধারণ শব্দ অনেকের জন্য অসহ্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই অদৃশ্য যন্ত্রণা ও মানসিক অস্বস্তির নাম মিসোফোনিয়া। আর এই বিষয়ের প্রতি সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর পালিত হয় World Misophonia Awareness Day—একটি দিন যা সেই সব মানুষের মানসিক লড়াইকে সামনে নিয়ে আসে, যাঁদের কষ্ট আমরা প্রায়শই বুঝতে পারি না।
‘মিসোফোনিয়া’ শব্দটির অর্থ হলো 'ঘৃণিত শব্দ'। এটি একটি নিউরো-সাইকোলজিকাল অবস্থা, যেখানে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে তীব্র বিরক্তি, রাগ, উদ্বেগ বা হতাশা সৃষ্টি করে। আশেপাশের মানুষজন যখন সেই শব্দের প্রতি উদাসীন থাকে, তখন এই সমস্যায় ভোগা ব্যক্তি নিজেদের নিঃসঙ্গ ও অসহায় বোধ করেন। কারণ অনেকেই এই সমস্যাটিকে গুরুত্ব দেন না বা একে মানসিক দুর্বলতা বলে এড়িয়ে যান।
বিশ্বের বহু মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি রয়ে গেছে অজানা, অচর্চিত এবং অবহেলিত। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম ট্রিগার শব্দ থাকে। কারও কাছে চিবানোর আওয়াজ অসহ্য, কারও কাছে নাক ডাকার শব্দ বা ঘড়ির টিকটিক ধ্বনি। এই শব্দ শুনলে অনেকের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপ, অস্থিরতা, এমনকি প্যানিক অ্যাটাকও হতে পারে। অনেক সময় ব্যক্তিরা এই শব্দ থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্বও তৈরি করে ফেলেন, যা একসময় বিষণ্ণতার কারণ হয়।
বিজ্ঞানীরা এখনো মিসোফোনিয়ার নির্দিষ্ট কারণ নির্ধারণ করতে পারেননি। ধারণা করা হয়, এটি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু সংযোগ ব্যবস্থার অস্বাভাবিকতার কারণে হতে পারে, যেখানে নিরীহ শব্দও তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে এটি কল্পনাপ্রসূত নয়—বরং এটি একটি বাস্তব ও বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত মানসিক অবস্থা।
World Misophonia Awareness Day আমাদের শেখায়, এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে। অনেকে না বুঝে উপহাস করেন বা হালকা করে দেখেন, যা আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে। সচেতনতা ও বোঝাপড়া থাকলে পরিবার, বন্ধু, সহকর্মীরা তাদের সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শও নেওয়া উচিত।
এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি মানুষের অনুভূতি আলাদা। কারও ভেতরের যুদ্ধ আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারি না। তাই মানুষের প্রতি সহানুভূতি, গ্রহণযোগ্যতা এবং সহযোগিতাই পারে একটি নিরাপদ, সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে। ছোট ছোট শব্দের যন্ত্রণায় যারা নীরবে কাঁদে, তাদের জন্য এই দিন হোক বোঝাপড়ার, আশার এবং ভালোবাসার নতুন বার্তা।