পিয়া রায়
প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো গুরু-শিষ্য পরম্পরা। এই ধারারই এক অনন্য উদযাপন হল গুরু পূর্ণিমা। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় এই পবিত্র দিনটি। গুরু—শব্দটির মধ্যে নিহিত রয়েছে আলোর পথপ্রদর্শক, অন্ধকার থেকে জ্ঞানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি। তাই গুরু পূর্ণিমা কেবল কোনো ধর্মীয় বা আচার-অনুষ্ঠানের দিন নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার এক মহান বার্তা।
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে গুরু মানে ঈশ্বরতুল্য। গুরুর স্থান সর্বোচ্চ আসনে। কারণ গুরুই শিষ্যকে আত্মবোধের শিক্ষা দেন, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য চিনতে সাহায্য করেন। বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত গুরু-শিষ্যের এই বন্ধন অবিচ্ছেদ্য থেকে গেছে। এই পূর্ণিমা তিথি ঋষি বেদব্যাসের জন্মদিন হিসেবেও পালন করা হয়, যিনি মহাভারতের রচয়িতা এবং সমগ্র বেদকে সংকলিত করার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়।
গুরু শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুসারে—‘গু’ মানে অন্ধকার আর ‘রু’ মানে আলো। অর্থাৎ যিনি অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো দেন, তিনিই গুরু। এই দৃষ্টিকোণ থেকে গুরু শুধু কোনো শিক্ষাপ্রদাতা বা ধর্মগুরু নন, গুরু হতে পারেন মা-বাবা, শিক্ষক, জীবনগুরু বা এমন কেউ যিনি আমাদের চিন্তায়, চরিত্রে, উপলব্ধিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
গুরু পূর্ণিমা পালনের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বৈদিক যুগের ঋষিরা নিজেদের জ্ঞানের আলোকছটা ছড়িয়ে দিতেন শিষ্যদের মধ্যে। তখনকার আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিষ্যরা গুরুদের কাছে গিয়ে জীবনদর্শন, নৈতিকতা, কর্ম ও ধর্মের শিক্ষা নিতেন। আর এই গুরুদের সম্মান জানাতে বিশেষ দিনে পালিত হতো গুরু পূর্ণিমা। সময়ের পরিক্রমায় এই দিনটি ভারতের সব ধর্ম, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান গুরুত্বের সাথে পালিত হতে শুরু করে।
আজকের সমাজেও গুরুর প্রয়োজনীয়তা কমেনি। বরং প্রযুক্তির দ্রুত গতির যুগে, মূল্যবোধের টানাপোড়েনে, উদ্বেগ ও অস্থিরতায় ভরা জীবনে গুরুর পথনির্দেশনা আরও বেশি প্রয়োজন। কারণ সত্যিকারের শিক্ষা কেবল পুঁথিগত জ্ঞান নয়, বরং জীবনের দর্শন, নৈতিকতা, সংযম, সহিষ্ণুতা আর মানবিকতার শিক্ষা।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ‘গুরু’ শব্দটির তাৎপর্য অনেকটাই কমে এসেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আজ হয়ে উঠেছে পরীক্ষামুখী, চাকরি কেন্দ্রিক। অথচ প্রকৃত গুরু সেই, যিনি শুধু বিদ্যা দেন না, শিষ্যের মনের অন্ধকার দূর করে, জীবনের দিশা দেখান। তিনি শিষ্যের আত্মবিশ্বাস জাগান, তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখান, সংকটে ছায়ার মতো পাশে থাকেন।
গুরু পূর্ণিমা আমাদের শেখায় কৃতজ্ঞতা। জীবনে আমরা যতদূর পৌঁছই না কেন, তার পেছনে কোনো না কোনো গুরুর অবদান থাকেই। হয়তো সেই শিক্ষক, যিনি প্রথম আমাদের হাতে কলম তুলে দিয়েছিলেন। হয়তো সেই ব্যক্তি, যিনি জীবনের কোনো কঠিন সময়ে আমাদের ভরসা দিয়েছিলেন। হয়তো মা, বাবা, দাদা, দিদিমা—যাঁরা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
এই দিনটি আত্মসমীক্ষারও। আমরা কি যথার্থ ছাত্র হতে পেরেছি? আমরা কি সত্যিকারের শিষ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি? কারণ গুরু-শিষ্য সম্পর্ক কেবল গ্রহণের নয়, এটি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও দায়িত্বেরও সম্পর্ক। গুরুর দেওয়া শিক্ষা, মূল্যবোধ, আদর্শ—এই সবই শিষ্যের চরিত্রের আয়না হয়ে ওঠে।
আজকের দিনে গুরু পূর্ণিমার গুরুত্ব আরও গভীর। প্রযুক্তির দুনিয়ায় আমরা প্রায়শই মানবিক সংযোগ হারিয়ে ফেলছি। অভিভাবকদের কথা অবহেলা করছি, শিক্ষকদের অবজ্ঞা করছি, নৈতিকতা ভুলে যাচ্ছি। অথচ এই মূল্যবোধের শিক্ষা ছাড়া জীবনে সঠিক পথ চলা যায় না। গুরু পূর্ণিমা মনে করিয়ে দেয়, আমাদের জীবনের প্রকৃত গুরুদের সম্মান করা উচিত, তাঁদের শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণ করা উচিত।
গুরু মানে নিঃস্বার্থ ভালবাসা। গুরু মানে সহানুভূতি ও ধৈর্য। গুরু মানে এমন একজন, যিনি শিষ্যের জীবনের প্রতিটি বাঁকে আশ্রয়ের মতো। জীবনের কোনো এক ধাপে হয়তো সেই গুরুর দেওয়া একটি উপদেশ, একটি বাক্য, একটি সাহসের স্পর্শ আমাদের সমস্ত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। গুরু পূর্ণিমা সেই চেতনার জাগরণ।
গুরু পূর্ণিমা শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বে পালিত হয়। অনেক যোগগুরু, ধ্যানগুরু, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক এই দিনে তাঁদের শিষ্যদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। শিষ্যরাও নানা ভাবে তাঁদের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন—প্রণাম, ফুল, উপহার কিংবা সেবার মাধ্যমে।
গুরু পূর্ণিমা মানে শুধু একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি এমন এক জীবনবোধ, যা প্রতিদিনের জীবনে চর্চা করতে হয়। প্রতিদিনের ক্ষুদ্র শিক্ষা, প্রতিদিনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতা থেকেও গুরুতুল্য শিক্ষা লাভ করা যায়। কারণ প্রকৃতির প্রতিটি সত্তাই কোনো না কোনোভাবে আমাদের শিক্ষা দেয়।
এই দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক—আমরা আমাদের গুরুর দেওয়া শিক্ষা অনুসরণ করব, মানবিকতা, নৈতিকতা, আদর্শকে জীবনের প্রতিটি কাজে বাস্তবায়ন করব। নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেব গুরু-শিষ্য সম্পর্কের গুরুত্ব, কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের অপরিহার্যতা। কারণ গুরুবিহীন জীবন মানে অন্ধকারের দিকে চলা, আর গুরুর আশীর্বাদ মানে আলোকিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা।
জীবনে সফলতা, শান্তি আর পরিতৃপ্তির জন্য প্রয়োজন গুরুর আশীর্বাদ ও শিক্ষার প্রতি অটুট বিশ্বাস। তাই গুরু পূর্ণিমার এই পবিত্র দিনে আসুন, আমরা সবাই নিজেদের জীবনের গুরুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি—কারণ তাঁরাই আমাদের চলার পথে আলো জ্বালিয়েছেন, জীবনের মানে বুঝিয়েছেন।
গুরু পূর্ণিমা শুভ হোক।