পিয়া রায়
ভারতে দুর্গাপুজো শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি এক বিরাট সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব, যা কোটি মানুষের জীবনে আনন্দ ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা এবং ত্রিপুরায় দুর্গাপুজো এক মহোৎসবে রূপ নেয়। কলকাতার দুর্গাপুজো বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে, যা ইউনেস্কোও ২০২১ সালে মানবতার অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি শুধু বাংলার নয়, সমগ্র ভারতের জন্য গর্বের বিষয়।
শারদীয় দুর্গাপুজো শুরু হয় মহালয়ার দিন থেকে, যখন দেবীপক্ষের সূচনা হয়। পঞ্চমী থেকে প্রতিমা উন্মোচন শুরু হয় এবং ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজার মাধ্যমে ভক্তরা দেবী দুর্গার উপাসনায় মেতে ওঠেন। অষ্টমীর অঞ্জলি এবং সন্ধিপুজো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ মণ্ডপে সমবেত হয়ে দেবীর চরণে অর্ঘ্য প্রদান করেন। নবমী পূজার পর দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার সমাপ্তি ঘটে, যা “বিজয়া দশমী” নামে পরিচিত। এই দিনটি দেবী দুর্গার বিজয়ের প্রতীক হলেও মানুষের জীবনে নতুন শুরুর বার্তাও বহন করে।
ভারতের দুর্গাপুজোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো প্রতিমা ও প্যান্ডেল শিল্প। কলকাতার কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা প্রতিমা গড়ার জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। মাটি, খড়, বাঁশ দিয়ে তৈরি প্রতিমাগুলো শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন। প্রতিবার প্রতিমার শৈল্পিক উপস্থাপনায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়। একইভাবে প্যান্ডেল সাজসজ্জাও এই উৎসবের বড় আকর্ষণ। বিভিন্ন থিমে তৈরি প্যান্ডেল—কখনও ঐতিহাসিক স্থাপত্য, কখনও আধুনিক শিল্পকলা, আবার কখনও সামাজিক বার্তাবাহী নকশা—মানুষকে মুগ্ধ করে। প্রতিযোগিতার আবহে মণ্ডপ সাজানো আজ এক আলাদা শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পূজাকে ঘিরে সারা শহর জুড়ে আলোসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, গান, নৃত্য ও কবিতা পাঠ মানুষের কাছে উৎসবের আনন্দ বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। বাংলার মানুষ যেমন নতুন পোশাক পরে পূজায় অংশ নেন, তেমনি আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিলনমেলা ও খাওয়া-দাওয়া এই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কলকাতার রাস্তা তখন রঙিন আলোকসজ্জা, ভিড় এবং প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে ওঠে। লাখো মানুষ দিন-রাত এক করে প্যান্ডেল হপিং করেন, যা শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের এক অনন্য দিক।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, ত্রিপুরা, ওডিশা এবং উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চলেও দুর্গাপুজো গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদসহ ভারতের অন্যান্য বড় শহরে অভিবাসী বাঙালিরা দুর্গাপুজো আয়োজন করেন, যা শহরগুলোর বহুসাংস্কৃতিক জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এইসব পূজা প্রবাসী বাঙালিদের জন্য শেকড়ের টান এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
ভারতে দুর্গাপুজো তাই শুধু দেবী দুর্গার আরাধনা নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির মহোৎসব, শিল্পকলার অসাধারণ প্রদর্শনী, সামাজিক মিলনমেলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ। প্রতিবছর আশ্বিন মাসে এই উৎসব বাঙালি জীবনের হৃদয়স্পন্দন হয়ে ওঠে, যা ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিল্পের সমন্বয়ে কোটি মানুষের জীবনে আনন্দ ও ভক্তির অমোঘ বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
ছবি: সংগৃহীত