পিয়া রায়
বাংলাদেশে দুর্গাপুজো আজ শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব এটি। প্রতিবছর আশ্বিন মাসে দেবীপক্ষের শুরুতে দুর্গাপুজো শুরু হয় এবং মহাষষ্ঠী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসব উদযাপিত হয়। প্রাচীনকাল থেকে দুর্গাপুজো গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতার প্রভাব থাকলেও, পূর্ববাংলার দুর্গাপুজো বিশেষভাবে পারিবারিক ও সামাজিক মিলনের রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পূজা চালু ছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তা আরও ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি পূজামণ্ডপে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানী ঢাকায় রমনা কালীমন্দির, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, শাঁখারীবাজারসহ বহু স্থানে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজারো ভক্ত-দর্শনার্থী সমবেত হন। চট্টগ্রামের জয়কালী মন্দির, খুলনার পূজামণ্ডপ, সিলেটের শ্রীশ্রীচণ্ডীঘাট মন্দির এবং রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোরসহ দেশের নানা অঞ্চলে দুর্গাপুজো এক অনন্য সামাজিক মিলনমেলায় রূপ নেয়। গ্রামের পুজোগুলোও স্থানীয় মানুষের ঐক্য, সহযোগিতা ও আনন্দ ভাগাভাগির প্রতীক হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের দুর্গাপুজোতে প্রতিমা তৈরির শিল্পকলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাঠামো বাঁশ ও খড় দিয়ে তৈরি হয়, তার ওপর কাদামাটি দিয়ে দেবী দুর্গা, মহিষাসুর, কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী ও লক্ষ্মীর প্রতিমা গড়ে তোলা হয়। প্রতিমার অলঙ্করণে মাটির কারিগরদের সৃজনশীলতা ও শৈল্পিকতা ফুটে ওঠে। পূজার দিনগুলোতে সকালে অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ বিতরণ, ভক্তিমূলক সঙ্গীত ও সন্ধ্যায় আরতি পরিবেশকে এক বিশেষ আবহে ভরিয়ে তোলে।
বাংলাদেশে দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতীক। পূজাকে ঘিরে নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, নাচ, প্রতিযোগিতা ও আলোসজ্জা মানুষকে একত্রিত করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও দুর্গাপুজো এখানে আন্তঃসম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিবছর মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষও দুর্গাপুজোর আনন্দ ভাগ করে নেন। সরকারিভাবে দুর্গাপুজো উপলক্ষে একাধিক দিন ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং প্রশাসন থেকে পূজামণ্ডপগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
বাংলাদেশের দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন। ঢাকায় বুড়িগঙ্গা, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি, খুলনায় ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য হাজারো মানুষ উপভোগ করে। প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শুধু একটি উৎসবের সমাপ্তিই ঘটে না, বরং তা মানুষের জীবনে নতুন আশা ও শক্তি সঞ্চার করে।
ফলে বলা যায়, বাংলাদেশে দুর্গাপুজো আজ একদিকে হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক, অন্যদিকে এটি সমগ্র জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির অনন্য সম্মিলন ঘটিয়ে এ উৎসব প্রতিবছরই লাখো মানুষের হৃদয়ে আনন্দ ও ভক্তির জোয়ার আনে।
ছবি: সংগৃহীত

