পিয়া রায়
নেপালে দুর্গাপুজো, যা সেখানে “দশাইন” নামে পরিচিত, দেশটির অন্যতম প্রধান ও সর্বজনীন উৎসব। এটি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নেপালের জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে দুর্গা দেবীর আরাধনা দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রীয় উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে। নেপালে দশাইন সাধারণত আশ্বিন মাসে পালিত হয় এবং প্রায় পনেরো দিন ধরে চলে। এই সময় দেবী দুর্গাকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজা করা হয়, যেখানে দেবীকে শক্তির প্রতীক হিসেবে আরাধনা করা হয়। দেবী দুর্গার বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুভ শক্তির জয় এবং অশুভ শক্তির পরাজয়ের প্রতীকী বার্তা সমগ্র জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
দশাইনের শুরু হয় ঘাটস্থাপন বা “ঘটস্থাপনা” দিয়ে। প্রথম দিনে পবিত্র ঘরে মাটি ও বালির উপর যজ্ঞকুণ্ডে যব বপন করা হয়, যা দেবীর আশীর্বাদে অঙ্কুরিত হয়ে ‘জমারা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই জমারা দশমীর দিনে দেবীর প্রতীক হিসেবে সবার মাথায় আশীর্বাদস্বরূপ রাখা হয়। দেবীপক্ষের প্রতিটি দিনই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। নবমী দিন নেপালে পশুবলি প্রথা এখনো বহুল প্রচলিত। বিশেষত মন্দিরে ছাগল, মহিষ বা হাঁস বলিদান করা হয় দেবীর উদ্দেশ্যে। যদিও সাম্প্রতিক কালে পশুবলির পরিবর্তে প্রতীকী বলি দেওয়ার প্রথাও শুরু হয়েছে।
দশমী বা বিজয়া দশমী নেপালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে বয়োজ্যেষ্ঠরা কনিষ্ঠদের কপালে লাল টিকা ও মাথায় জমারা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এ দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ নেপালের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সবাই এই প্রথায় অংশগ্রহণ করেন। এটি সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার পাশাপাশি পারিবারিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। গ্রামের মানুষজন থেকে শহরের নাগরিকরা, সবাই নতুন পোশাক পরিধান করেন, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে যান এবং আনন্দ-উৎসবে অংশ নেন।
নেপালে দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকারি দপ্তর, স্কুল-কলেজ সবই দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ থাকে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে, নানান সাংস্কৃতিক আয়োজন হয়। এই সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতিও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে—নতুন পোশাক, খাদ্যসামগ্রী, পশু ক্রয়-বিক্রির মাধ্যমে উৎসব ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য জমে ওঠে।
বাঙালি দুর্গাপুজোর সঙ্গে নেপালি দশাইনের অনেক মিল থাকলেও একটি বড় পার্থক্য হলো—বাংলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুজো মূলত প্রতিমা নির্ভর, যেখানে নেপালে গুরুত্ব দেওয়া হয় পূজার আচার, জমারা এবং টিকা দেওয়ার মতো প্রতীকী দিকগুলিতে। ফলে নেপালের দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় ভক্তির প্রকাশ নয়, বরং জাতির ঐক্য ও সংস্কৃতির পরিচয় বহনকারী এক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি নেপালিদের জন্য শক্তি, ঐক্য ও আশীর্বাদের প্রতীক, যা দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আজও অটুট করে রেখেছে।
ছবি: সংগৃহীত