পিয়া রায়
শ্রীলঙ্কায় দুর্গাপুজো ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ হলেও, এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন, বিশেষত উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে তামিল হিন্দুরা। তাঁদের ধর্মীয় জীবনযাপনে দুর্গাপুজো এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে এই পুজো মূলত প্রচলিত হিন্দু আচার ও রীতিনীতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে প্রচলিত দুর্গাপুজোর থেকে কিছুটা ভিন্ন। শ্রীলঙ্কায় দুর্গাপুজো বিশেষত কাতারগামা, জাফনা, ত্রিনকোমালি এবং কলম্বো শহরের হিন্দু মন্দিরগুলোয় অনুষ্ঠিত হয়। এসব মন্দিরে দেবী দুর্গাকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে আরাধনা করা হয় এবং শাস্ত্রোক্ত নিয়মে পূজা সম্পন্ন হয়।
দুর্গাপুজো সাধারণত নবরাত্রির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তা নয় রাত ধরে চলে। এই সময়ে দেবীকে নানাভাবে পূজা করা হয়—অলঙ্কার, প্রদীপ, ফুল এবং ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমী ও নবমী বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ভক্তরা উপবাস পালন করেন এবং দেবীর আরাধনায় অংশ নেন। শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুরা দেবীর কাছে বিশেষভাবে প্রার্থনা করেন অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি, পরিবার ও সমাজের মঙ্গল এবং শস্যসমৃদ্ধ জীবনের জন্য। দেবী পূজার সময় মন্দিরগুলোয় শঙ্খধ্বনি, ঢাকঢোল ও ভক্তিগান পরিবেশিত হয়, যা উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
কলম্বোতে বসবাসরত বাঙালি সম্প্রদায়ও দুর্গাপুজো পালন করে থাকেন। তাঁদের আয়োজন তুলনামূলক ছোট হলেও তা ভক্তির গভীরতায় সমৃদ্ধ। বিশেষত ভারতীয় হাইকমিশন ও প্রবাসী বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে দুর্গাপুজো পালিত হয়। এখানে ভারতের মতো বড় প্রতিমা তৈরি করা হয় না; বরং মন্দির বা হলঘরে প্রতীকী প্রতিমা বা ছবির সামনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ এবং দশমীর মিলনমেলায় প্রবাসীদের মিলিত আনন্দ একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে।
শ্রীলঙ্কায় দুর্গাপুজো কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতির উপস্থিতি ও প্রভাবের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। এই উৎসব স্থানীয় হিন্দু সমাজের পাশাপাশি প্রবাসীদের জন্যও পরিচয় ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে উঠেছে। উৎসবের মাধ্যমে দ্বীপদেশের বহুসাংস্কৃতিক চরিত্র আরও স্পষ্ট হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সহাবস্থান যেখানে দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে, সেখানে দুর্গাপুজো প্রমাণ করে ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব।
ফলে শ্রীলঙ্কায় দুর্গাপুজো শুধু দেবী দুর্গার পূজাই নয়, বরং তা এক বহুস্বরিক ঐতিহ্যের প্রতীক, যা মানুষকে ভক্তি, ঐক্য ও আনন্দের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
ছবি: সংগৃহীত