রাজীব সিকদার
১৪ বছর ধরে প্রত্নতত্ত্বের পঠন পাঠন গবেষণা করলাম। নদীর ধারে, প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলে, মাটির নিচ ও উপর পৃষ্ট থেকে প্রাচীন প্রস্তর, মধ্য প্রত্ন প্রস্তুর, নিম্ন প্রত্ন প্রস্তর যুগের পাথরের হাতিয়ার পেলাম । আদি মধ্যযুগের নানান ধরনের মূর্তি পেলাম। আর মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত স্থান ভেদে নানান কল্পনায় শিল্পী দ্বারা নির্মিত দেব দেবীর মূর্তি দেখলাম। মূর্তি নির্মাণে মাটি, কাঠ, পাথর আর নানান ধাতু দেখলাম। বুঝলাম যখন যা সহজলভ্য তা নিয়েই স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সব মূর্তির নির্মাণ হয়েছে।
সাথে সাক্ষী থাকলাম আদিবাসী, যাযাবর, প্রান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন রীতিনীতি, অভ্যাস, সংস্কৃতির। বাকি প্রাথমিক জীবনে দেখলাম রংবেরঙের ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও শুনলাম তাঁদের কথাবার্তা। জটাধারী সাধুর সাথে ঘুরলাম, খেলাম, ঘুমালাম। ঠাকুর পুজো করলাম জীবনের প্রথম আঠারো বছর। কিন্তু, কোথাও মনে হলো না বাস্তবে ঈশ্বর বলে কিছু আছে। সবই যেন বোঝা না বোঝার ছলে মানুষের মনের নীলনক্সা।
আসলে যুগে যুগে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত বদলানোর সাথে জীবন ও প্রকৃতির অজানা ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষের মনস্তত্ত্বে বিচিত্র ধরনের কল্পনার খেলা চলে । যা সমাজের নানান স্তরে নানান ভাবে ছাপ রেখে যায়। তাই দিয়েই ঋতু ভেদে যত পুজো আনাগোনা, মূর্তি নির্মাণ বা দেব দেবীর মানসিক বন্দনা। বাস্তব দুনিয়ায় সবই শূন্য। অতীত ইতিহাসও একই কথা বলে। নিত্যদিনের ব্যাক্তিগত জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের কার্যকারণ অনুসন্ধানও সেই ঘুরে ফিরে মানুষকে দায়ী করছে, কোনো অলীক বস্তুকে নয়। ঈশ্বর কোথাও পাচ্ছিনা। তাও কয়েক হাজার বছর ধরে সারা সমাজ, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু একসাথে যখন দেব দেবীর নামে চিৎকার করছে, নানান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করছে তখন মনের মধ্যে আবার তাঁদের প্রতি সামান্য সায় এলেও জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা মনকে সায় দিচ্ছে না ঈশ্বরের ধারণার প্রতি।
এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ওসিয়ানিয়া জুড়ে বন্যা, ক্ষরা, ভূমিকম্প, দাবানল, যুদ্ধ, শোষণ, নিপীড়নের যত কাহিনী শুনছি তার কারণ অনুসন্ধান করছি তার অধিকাংশটাই মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। আর সামান্য কিছু ঘটছে ভূপৃষ্ঠে ও অভ্যন্তরের ভৌত ও রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপের ফলে। এটা এক অনুভূতি, যে অসহায় ও নিরুপায় মানুষের বাঁচবার আশা আর করুণ আর্তিই যেন ভগবান, গড কিম্বা আল্লাহ শব্দগুলো সৃষ্টি করে যাচ্ছে। তাই, শুনেই পৃথিবীর সকল অসহায় ও নিরুপায় মানুষ ঈশ্বরের একই স্বর ও সুর সৃষ্টি করছে। ধ্বনিত করছে আকাশ - বাতাস। এই অসহায় মানুষের চোখের জলই মনস্তত্ত্বে ঈশ্বর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রচনা হচ্ছে সংস্কৃতির নানান সুর। অন্যদিকে রংবেরং ও নানান শৈলীর মূর্তিগুলো যে আসলে একটা বুজরুকির ধারাবাহিক ও সম্মিলিত প্রয়াস তা যেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের ধারাবাহিক প্রচারের ঢক্কানিনাদে চিন্তার অনেক গভীরে তলিয়ে গেছে। সত্য খুঁজবার বুঝবার সাধ্য নেই কারোর। প্রদর্শন চলছে নানান শৈলীর দেবদেবীর। কোথাও বা তা ভেক আর কোথাও ভক্তি। সব কিছুর নেপথ্যেই ঘুরে ফিরে মানব মস্তিষ্কের চতুর খেলা।