শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আজ যদি আমি বুঝিতে পারিতাম, আমার পরিচিত আত্মীয় - স্বজন বন্ধু বান্ধবেরা সবাই আমাকে ভুলিয়া গিয়াছেন - আমি সুখী হইতাম, শান্তি পাইতাম ! তা হইবার নয়। আমাকে ইঁহারা স্মরণ করিবেন, সন্ধান জানিতে চাহিবেন, বিচার চাহিবেন এবং অনবরত আমার অধোগতির দুঃখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া আমার মর্মান্তিক দুঃখের বোঝা অক্ষয় করিয়া রাখিবেন। লোকে যে আমার কাছে কি আশা করিয়াছিলেন, কি পান নাই, এবং কি হইলে যে আমাকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন, এ যদি আমাকে কেহ বলিয়া দিতে পারিত, আমি চিরটা কাল তাঁহার কাছে কৃতজ্ঞ থাকিতাম। আমি মরিয়া গিয়াছি - এই কথাটা যদি কোনোদিন কাহারও দেখা পাও - বলিয়ো ।
তাই বলিয়া, তুমি যেন দুঃখ পাইয়ো না। তোমাকে আমি ভয় করি না। কেন না, তুমি বোধহয় আমার বিচার করিবার গুরুভার লইতে চাহিবে না। তাই তোমার কাছে আরো কয়টা দিন বাঁচিয়া থাকিলেও ক্ষতি হইবে মনে করি না। তুমি আমার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী ।
আমার সম্বন্ধে কিছু জানিতে চাহিয়াছ - তাহা সংক্ষেপে কতকটা এইরূপ -
(১) শহরের বাহিরে একখানা ছোটো বাড়ীতে মাঠের মধ্যে ও নদীর ধারে থাকি।
(২) চাকরি করি। ৯০ টাকা মাহিনে এবং ১০ টাকা অ্যালাউন্স পাই । একটা ছোটো চায়ের দোকানও আছে। দিনগত পাপক্ষয়, কোনোমতে কুলাইয়া যায়, এই মাত্র। সম্বল কিছুই নাই।
(৩) হার্ট ডিজিজ আছে। কোনো মুহুর্তেই....
(৪) পড়িয়াছি বিস্তর। প্রায় কিছুই লিখি নাই। গত দশ বৎসর ফিজিওলজি, বায়োলজি এন্ড সাইকোলজি এবং কতক হিস্ট্রি পড়িয়াছি। শাস্ত্রও কতক পড়িয়াছি।
(৫) আগুনে পুড়িয়াছে আমার সমস্তই। লাইব্রেরী এবং 'চরিত্রহীন ' উপন্যাসের ম্যানুস্ক্রিপ্ট। প্রায় ৪০০। ৫০০ পাতা লিখিয়াছিলাম। তাও গেছে। ইচ্ছা ছিল যা হোক একটা এই বৎসর পাবলিশ করিব। আমার দ্বারা কিছু হয়। এ বোধহয় হইবার নয়। তাই সব পুড়িয়াছে। আবার শুরু করিব। এমন উৎসাহ পাই না। ' চরিত্রহীন ' ৫০০ পাতায় শেষ হইয়াছিল - সবই গেল।
.........আর একটা সম্বাদ তোমাকে দিতে বাকি আছে। বছর তিনেক আগে যখন 'হার্ট ডিজিজ ' এর প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাই তখন আমি পড়া ছড়িয়ে 'ওয়েল পেন্টিং' শুরু করি। গত তিন বৎসর অনেকগুলি 'ওয়েল পেন্টিং' সংগ্রহ হইয়াছিল। তাও ভস্ম হইয়াছে। শুধু আঁকিবার সরঞ্জামগুলা বাঁচিয়াছে ।"
তথ্যসূত্র: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: প্রমথ নাথ ভট্টাচার্যকে লেখা চিঠি, ১২-০৩-১২, ডি এ জি অফিস, রেঙ্গুন।
তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা: রাজীব সিকদার, কলকাতা