নরেন্দ্রনাথ কুলে
ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি । তাঁর পাণ্ডিত্য তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বারিধারার মত বিতরণ করেছেন । তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন ভারতে শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজের প্রধান প্রতিনিধি । তাঁর অধীনে দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন হল । স্বাধীন দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে তার খসড়া তৈরি করলেন । সেই খসড়ার প্রথমে শিক্ষা ও শিক্ষক সম্বন্ধে যে কথাটি বললেন তা হল --- 'শিক্ষা হল যে কোনো জাতির মেরুদণ্ড তাই শিক্ষা ব্যবস্থা সুগঠিত হলে জাতিও সুন্দর হয়ে ওঠে । আর যেহেতু শিক্ষক হল শিক্ষা ব্যবস্থার ধারক তাই কমিশনের মতানুযায়ী শিক্ষককে হতে হবে যোগ্যতম ব্যক্তি, যাঁকে শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে ।'
এই সময়টা শিক্ষাক্ষেত্র, শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের মধ্যে তাঁর কথার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যায় কি ? এই সময় শিক্ষাব্যবস্থার চিরকালীন প্রথাটা যেন সব ওলটপালট করে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকারি স্কুল তুলে দিচ্ছে, ক্লাসের পড়া নেই, শিক্ষক নেই, পরীক্ষা নেই । এই পরিস্থিতিতে আবার অন লাইন ক্লাসের বাজার চালু হয়েছে। এমনতর ব্যবস্থায় রাধাকৃষ্ণন কমিশনে যা বলা হয়েছে-- শিক্ষক হবে যোগ্যতম ব্যক্তি যাাঁকে শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে, তা কিভাবে সম্ভব হবে । ব্যক্তির সংস্পর্শে না-থাকলে তিনি যোগ্যতম বলে বিবেচিত হবেন কি করে । শিক্ষকের সংস্পর্শ ছাড়া শিক্ষা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না । যে সম্পর্কে তৈরি হয় জাতির মেরুদণ্ড । ক্লাসরুমে পাঠ্যপড়া ছাড়া মাঝেমাঝে শিক্ষকের নানা অভিজ্ঞতাসহ সমাজের নানা ঘটনার আলোচনা ছাত্রদের সমৃদ্ধ করে । ক্লাসরুম না থাকলে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক গড়়ে ওঠে না । তাহলে আজকে অনলাইন ক্লাস সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না । অথচ অনলাইন ক্লাসের গুরুত্ব নিয়ে বহু গুরুগম্ভীর কথা শিক্ষানীতির পাতায় বলা হয়েছে।
অনলাইন শিক্ষার অনেক আগেই এদেশে 'দূর শিক্ষা' ব্যবস্থা চালু হয়েছে । যেখানে শিক্ষক ও ছাত্র সম্পর্ক বলতে কিছু নেই । এখন এই দূূরায়ত শিক্ষাকে ক্লাসরুমের সমমানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে । এই দূরায়ত শিক্ষাকে মুক্ত-শিক্ষাও বলা হয় । যা শিক্ষক ছাড়া । শুধু স্টাডি মেটেরিয়াল নির্ভর শিক্ষা । সত্যি, শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা ত মুক্ত শিক্ষাই । এই মুক্ত শিক্ষার জন্য এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই । আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলে শিক্ষকের প্রয়োজন নেই । শিক্ষক না থাকলে শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব নেই । অনেকেই বলতে পারেন, তা হয় নাকি । এমন মুুুক্ত-শিক্ষা র জন্য পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে নাকি । এ প্রশ্ন নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতির দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে । এই শিক্ষানীতিতে মুক্ত ও দূরায়ত শিক্ষা এবং অনলাইন শিক্ষা ভবিষ্যতের বিকল্প শিক্ষা হবে বলে বলা হয়েছে । প্রশ্ন হল এই শিক্ষা প্রথাগত মূল শিক্ষার সহায়ক হতে পারে, কিন্তু বিকল্প হতে পারে কি ?
ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ও তাদের মধ্যে চিন্তার আদান-প্রদানের ভূমিকা অপরিসীম । এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না । অনলাইন ও দূরায়ত মুক্ত শিক্ষাকে সমমানের মর্যাদা দেওয়া মানেই প্রথাগত শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করা । আর প্রথাগত শিক্ষা গুরুত্বহীন হলে শিক্ষাবিস্তারে নতুন নতুন প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আর সেভাবে হবে না । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন না থাকলে শিক্ষকের প্রয়োজন নেই । আর এই যদি শিক্ষার পলিসি হয় অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষক-সমাজ বলে তার অস্তিত্ব থাকবে কি ? তাহলে দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন রাধাকৃষ্ণন কমিশনের মতে, শিক্ষক হবে যোগ্যতম ব্যক্তি যাাঁকে শিক্ষার্থীরা অনুসরণ করবে, তা আর সম্ভব হবে না । যদি তা সম্ভব না হয়, আদর্শ শিক্ষক বলে কথাটা আর ছাত্রদের কাছে থাকবে না । যদিও নতুন শিক্ষানীতিতে একজায়গায় বলা হয়েছে শিক্ষক পদের পরিবর্তে থাকবে 'ইনস্ট্রাকটর' । এই ইনস্ট্রাকটের কাজ করতে এখন 'অ্যাপ' এসে গেছে । তাহলে সেই ইনস্ট্রাকটরও ছাত্রের সামনে না থাকলেও চলবে । তার মানে শিক্ষক না থাকলে শিক্ষক দিবসও থাকবে না । আজকের সময়ে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের যে বাস্তব চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তার আন্দাজ শিক্ষক সমাজ সহ গোটা সমাজ না-ভাবলে, রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনে শিক্ষক দিবস পালনের সার্থকতা আছে কি ?