নরেন্দ্রনাথ কুলে
এই মূহুর্তে একটি নাম । অনুপর্ণা । চলচ্চিত্র শিল্পী । আজ এ দেশের এই শিল্পে তাঁর মুখ পরিচিত নয় । অথচ এই মূহুর্তে তাঁর মুখ সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে পরিচিত হয়েছে । তাঁকে আলাদা করে পরিচয় করে দেওয়ার আর কারও প্রয়োজন নেই। অবশ্য সেই প্রয়োজন যে প্রয়োজন থেকে এখন আসে তা তাঁর জন্য বরাদ্দ হতে পারে না । আজকে যাঁদের খুশি করে শিল্প-সাহিত্যে বেঁচে থাকা যেতে পারে বলে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেই পরিবেশে অনুপর্ণা বেমানান। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হাতে প্যালেস্টাইনের শিশুদের জন্য পৃথিবীর অসহায় শিশুদের জন্য বলতে গিয়ে যে মেয়েটির স্বর কেঁপে ওঠে সেই মেয়েটি আজকের দিনে তথাকথিত অভিযোজিত অভিজাত পরিবেশে আলোচিত হতে পারে না । শুধু তাই নয় যে-মেয়েটি নিজের রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিস্ময়কর প্রশ্ন প্রকাশ করতে পারে, এমনকি তার জন্য পরোয়াহীন মন্তব্য ব্যক্ত করতে পারে, সেই মেয়েটি এ দেশের এই সময়ের শিল্প সমাজে খাপছাড়া । এই মূহুর্তে এ দেশের শিল্প সমাজ থেকে হয়তো সে একমাত্র প্রতিনিধি যে প্যালেস্টাইনের শিশুদের জন্য স্বর ব্যক্ত করেছে । কিন্তু গোটা দেশের শিল্প সমাজ তাঁর জন্য গর্ববোধ করবে কিনা তা ও সে পরোয়া করবে না ।
এখন যে সময় চলছে সেখানে অন্যায়কে অন্যায় বলা সহজ নয় । শিল্প, সাহিত্য সমাজের অধিকাংশই আজ সেই সহজ পথে সহজভাবে চলতে পারছে না । অথচ মানুষের জন্য, সমাজের জন্য হৃদয়ের বেদনা অনুভূত না হলে শিল্প, সাহিত্য সৃষ্টি নিছক 'টাইম-পাস' হতে পারে কি ? শিল্প ও শিল্পী কখনও আপষের পথে চলতে পারে না । দুঃসময়ের প্রতিবাদে শিল্পী তাঁর শিল্পকে সমৃদ্ধ করেই তৃপ্তিলাভ করতে পারে । এ সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক তাঁর শিল্প-জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন। সমাজের প্রয়োজনে, সংস্কৃতির প্রয়োজনে, শিল্পের প্রয়োজনে তাঁর মতে যেটা করার তার জন্য কোনভাবেই কোন স্তরে তিনি আপোষের পথকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করেন নি । তাঁর এই অদম্য মনোভাব নিয়ে তিনি আজীবন চলেছেন । তাঁর কথায়, 'আমৃত্যু আমার জীবনে কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব নয় । সম্ভব হলে তা অনেক আগেই করতাম এবং ভালো ছেলের মতো বেশ গুছিয়ে বসতাম । কিন্তু তা হয়ে উঠল না, সম্ভবত হবেও না । তাতে বাঁচতে হয় বাঁচব, না হলে বাঁচব না । তবে এইভাবে শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে চাই না ।'
আজকে অনুপর্ণা র কাঁপা স্বর তাঁর শিল্পসত্তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ। মানুষের জন্য যে শিল্পী কাঁদতে পারে, সেই শিল্পী সময়ের অভিযোজনে ভেসে যাবে না । এ বিশ্বাস যেন নতুন করে অনুপর্ণা এক ভিত । আজকের সময়ে তাঁর পরোয়াহীন প্রতিবাদের কন্ঠ দিকে দিকে শিল্প সমাজে তার অনুরণন তুলুক যা অত্যন্ত প্রয়োজন এই সময়ে। হয়তো বেমানান, তবু আজ তার প্রয়োজন ।