Select language to read news in your own language


Like SatSakal Facebook Page to stay updated.

রামরাজাতলার রাম মন্দির: হাওড়ার হৃদয়ে গাঁথা শতাব্দীপ্রাচীন এক ধর্মীয় ঐতিহ্য


পিয়া রায়যোগমায়া আচার্য

 

হাওড়ার রামরাজাতলা অঞ্চলে অবস্থিত একটি মন্দির শুধু প্রাচীন ধর্মস্থান নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস, যার শিকড় বিস্তৃত বহু শতাব্দী পেছনে। এই রাম মন্দির স্থানীয় জনগণের হৃদয়ে যে জায়গা দখল করে আছে, তা কেবল পূজা-অর্চনার জন্য নয়, বরং এক সমাজজীবনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে।

মন্দিরের অবস্থান থেকেই বোঝা যায় তার মাহাত্ম্য। ‘রামরাজাতলা’ নামটি যেমন ঐতিহাসিকভাবে এই মন্দিরের উপস্থিতিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে, তেমনি কথিত আছে, এই স্থানেই রাজা রূপে স্বয়ং ভগবান রামের আরাধনা হয়েছিল। সেই থেকেই জায়গাটির নাম—রাম-রাজা-তলা। কথাটি শুধু কাহিনি নয়, স্থানীয় সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক বিশ্বাস। প্রায় তিন শতাব্দী আগে, ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই মন্দিরের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন হয়, যদিও তারও আগে রামচন্দ্রের পূজা চলত বলে লোকপ্রচলিত কথা রয়েছে। এই গঠন পর্বে মুখ্য ভূমিকা ছিল তৎকালীন জমিদার ও ধর্মপ্রাণ স্থানীয় মানুষদের।

মন্দিরটির স্থাপত্যচরিত্রও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। একদিকে বাঙালি মন্দির স্থাপত্যের সহজসাধ্যতা, অন্যদিকে উত্তর ভারতের প্রভাবে তৈরি শোভামণ্ডিত গঠন। মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজমান ভগবান রাম, সীতা, লক্ষ্মণ ও হনুমান—চতুর্ভুজ, অলংকৃত এবং শোভন রূপে। দৈনন্দিন পূজায় তাঁদের আরাধনায় নিয়োজিত আছেন দক্ষ পুরোহিতেরা। যদিও মন্দিরের কিছু অংশে আধুনিককালের সংস্কার কাজ হয়েছে, তবু মূল স্থাপত্যের ঐতিহ্য বজায় রাখা হয়েছে পরম যত্নে।

এই মন্দিরের সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্মীয় আয়োজন হল রামনবমী। চৈত্র মাসে রামজন্ম উপলক্ষে যে উৎসব আয়োজিত হয়, তা হাওড়া তথা দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ। একসময় রামলীলা নাট্যদল ও কীর্তনীয়া দলের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল, যা আজও কোনও কোনও বছর আয়োজিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দিন মন্দির প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হন, তাঁদের মধ্যে বহুজন বহু দূর থেকে আগত। এছাড়াও দশেরা ও দীপাবলির সময়েও বিশেষ পূজার আয়োজন হয়, যার মাধ্যমে মন্দিরে ভক্তি ও উৎসবের প্রবাহ বজায় থাকে।

এই মন্দির শুধুমাত্র পূজার জায়গা নয়, বরং একটি শক্তিশালী সামাজিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাইরেও এখানে আয়োজিত হয় ভোগ বিতরণ, সমাজসেবা কার্যক্রম, এমনকি বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। রাম মন্দিরকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই সমাজজীবনের বহুমাত্রিক চিত্র হাওড়ার সংস্কৃতিকে এক শক্ত ভিত্তি দেয়। বহু পরিবার এই মন্দিরকে তাঁদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে, এবং এখানে উপস্থিত হলে যেন এক অন্তরঙ্গ আধ্যাত্মিক যোগাযোগ অনুভব করেন।

বর্তমানে মন্দিরটি পরিচালিত হয় একটি সুসংগঠিত ট্রাস্ট বোর্ডের অধীনে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় উৎসব-অনুষ্ঠান ও প্রতিদিনের পূজাপদ্ধতি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পালিত হয়। নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, এবং জনসেবামূলক আয়োজন—সব কিছুরই সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা থাকে মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে।

এই রাম মন্দির শুধু হাওড়ার নয়, সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের এক প্রাচীন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। এর গায়ে লেগে আছে শত শত বছরের ইতিহাস, বিশ্বাস ও মানুষের আবেগ। এখানে শুধু পূজা হয় না—গড়ে ওঠে সম্পর্ক, উৎসব, ঐতিহ্য এবং সময়ের ধারায় এক অবিচল আস্থা। এই মন্দির এক ঐশ্বরিক ছায়া হয়ে আজও রামরাজাতলার হৃদয় জুড়ে জ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে আলো দিয়ে চলে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

যতদিন রামের নাম শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হবে, ততদিন এই মন্দির তার গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে মানুষের মনে জ্বলন্ত স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে বিরাজ করবে।

 

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon