পিয়া রায়
ক্যালেন্ডার মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য আবিষ্কার। দিনের পর দিন, ঋতুর পরিবর্তন, চন্দ্র ও সূর্যের গতি—সব মিলিয়ে মানুষ যখন সময়ের ধারণাকে ধরতে শিখল, তখনই জন্ম নিল ক্যালেন্ডার। কিন্তু প্রতিটি আবিষ্কারের মতো ক্যালেন্ডারেরও একটি দীর্ঘ যাত্রাপথ রয়েছে, যেখানে ভুল, সংশোধন আর নতুনত্ব মিলেই গড়ে উঠেছে বর্তমানের সময়ের এই মানচিত্র। সেই সংশোধনের দিনকেই আমরা চিনি Calendar Adjustment Day নামে।
পুরনো যুগে মানুষ সময় মাপত চাঁদের ওঠা-নামার উপর নির্ভর করে। পরে সূর্যের গতি হিসেব করে তৈরি হয় সৌর ক্যালেন্ডার। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, কারণ পৃথিবীর আবর্তন আর সূর্যের গতি পুরোপুরি মিলল না মানুষের বানানো হিসেবের সঙ্গে। একদিকে দিন বছর ধরে ছোট বা বড় হচ্ছিল, অন্যদিকে উৎসব-আচার-ঋতু পিছিয়ে যাচ্ছিল সময়ের সঙ্গে। এভাবেই সামনে আসে ক্যালেন্ডার সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা।
খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত নানা জাতি নিজস্ব ক্যালেন্ডার তৈরি করেছে। তবে ইউরোপে দীর্ঘ সময় চালু ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল, এই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে প্রকৃত সৌর বছরের ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। ঋতু আর উৎসব এগিয়ে বা পিছিয়ে যেতে শুরু করেছিল। যেমন—বসন্তের উৎসব ক্রমশ গ্রীষ্মের দিকে সরে যাচ্ছিল। তখনই পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশের উদ্যোগে ১৫৮২ সালে জন্ম নেয় নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, যা আজও বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত। সেই সময় ক্যালেন্ডার ঠিক করতে কয়েকটি তারিখ বাদ দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডে ১৭৫২ সালে ২ সেপ্টেম্বরের পরের দিনটি ছিল সরাসরি ১৪ সেপ্টেম্বর! এই আকস্মিক পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল, অনেকে এমনকি প্রতিবাদও করেছিল, কারণ তারা বিশ্বাস করত জীবনের কয়েকদিন হঠাৎ কেটে গেল।
ক্যালেন্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট ডে আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সময় কেবল একটি পরিমাপ নয়, বরং সভ্যতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক বাস্তবতা। আজ আমরা যখন মোবাইল বা কম্পিউটারে এক ক্লিকেই সময় ও তারিখ জেনে নিই, তখন ভাবাই যায় না, সেই সময় মানুষকে কতটা জটিল সংশোধনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল।
আজকের দিনে ক্যালেন্ডার শুধু সময়ের হিসেব রাখার মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার, উৎসব, এমনকি জাতীয় জীবনের অন্যতম ভিত্তি। জন্মদিন থেকে রাষ্ট্রীয় দিবস—সবকিছু ক্যালেন্ডারের তারিখের উপর নির্ভরশীল। তাই ক্যালেন্ডারের নির্ভুলতা ছাড়া সভ্যতার সঠিক অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়।
Calendar Adjustment Day আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষের জ্ঞানের অভিযাত্রা কতদূর বিস্তৃত, এবং প্রতিটি ক্ষুদ্র সংশোধনই বৃহৎ পরিবর্তনের অংশ। সময়ের এই নির্ভুল হিসেব না থাকলে হয়তো আমরা আজকের মতো সুসংগঠিত সমাজ গড়ে তুলতে পারতাম না। ক্যালেন্ডারের ইতিহাস তাই শুধু দিনের হিসেব নয়, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রারই এক উজ্জ্বল অধ্যায়।