পিয়া রায়
ভারত মহাসাগরের পশ্চিমে অবস্থিত ফরাসি উপনিবেশিক অঞ্চল রিইউনিয়ন দ্বীপ (La Réunion), যেখানে ইউরোপীয় শাসনব্যবস্থার মাঝে দক্ষিণ ভারতীয় ও হিন্দু সংস্কৃতির এক দুর্লভ মিশ্রণ দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠেছে। এখানে দুর্গাপূজা যদিও সংখ্যায় সীমিত, তবুও এটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত সমাজের ঐতিহাসিক পরিচয়, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির টিকে থাকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৮শ ও ১৯শ শতকে ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে তামিলনাড়ু ও পন্ডিচেরি অঞ্চল থেকে বহু ভারতীয় শ্রমিক আনা হয়েছিল রিইউনিয়নে চিনির খামারে কাজের জন্য। এই 'ইন্ডেন্টার্ড লেবার' বা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের একটি বড় অংশ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী তামিল ও তেলেগু ভাষাভাষী, যারা তাদের নিজস্ব দেবদেবীর পূজা, উৎসব ও আচার রক্ষার মাধ্যমে এক নতুন ভূখণ্ডে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরম্পরা গড়ে তোলে। সময়ের পরিক্রমায়, এঁদের বংশধররাই আজকের রিউনিয়নের ভারতীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক।
রিইউনিয়নে হিন্দু ধর্ম একটি স্বীকৃত ধর্ম নয়; বরং এটি “Association Culturelle” (সাংস্কৃতিক সংস্থা)-র আকারে চর্চিত হয়। এখানে শিব, মুরুগান, মারিয়াম্মান প্রভৃতি দক্ষিণ ভারতীয় দেবদেবীর পূজা বেশি প্রচলিত। তবুও সাম্প্রতিক দশকে রিইউনিয়নের হিন্দু সমাজে দুর্গা পূজার প্রভাবও বাড়তে শুরু করেছে, বিশেষত উত্তর ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত নতুন অভিবাসীদের মাধ্যমে।
দুর্গাপূজা সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট মন্দিরে বা হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্লাবঘর বা অ্যাসোসিয়েশনের হলে আয়োজিত হয়। যদিও এখানে বিশালাকৃতির প্রতিমা দেখা যায় না, তবুও দেবী দুর্গার চিত্র বা ছোট মূর্তির সামনে চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি ও ভক্তিসঙ্গীতের মাধ্যমে একটি ঘরোয়া, অথচ গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে পূজা সম্পন্ন হয়। অনুষ্ঠানগুলোতে শুধুমাত্র ভারতীয় বংশোদ্ভূতই নন, অনেক সময় স্থানীয় ক্রিয়োল (Creole) বা আফ্রো-ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মানুষও অংশ নেন, যা রিউনিয়নের অন্তঃসম্পর্কিত সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রমাণ।
ফ্রান্সের অধীনস্থ রিইউনিয়নে ধর্মীয় স্বাধীনতা সংবিধানিকভাবে নিশ্চিত। এখানকার প্রশাসন পূজা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে সহনশীল, যদিও আনুষ্ঠানিক মন্দির প্রতিষ্ঠা বা সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হিন্দু সংগঠনগুলো মূলত নিজেদের অর্থে এবং কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তায় পূজার আয়োজন করে থাকে।
রিউনিয়নে দুর্গাপূজা কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে নিজস্ব শিকড়ে ফিরে তাকানো, সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখার এবং নতুন প্রজন্মকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার একটি প্রয়াস। ফরাসি ভাষাভাষী এই দ্বীপে হিন্দি, তামিল বা বাংলা ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ শোনা গেলে, সেটি যেন ইতিহাসের সংলাপের মতো প্রতিধ্বনিত হয়।
রিইউনিয়নে দুর্গাপূজা একটি নিঃশব্দ সংস্কৃতিক বিপ্লব—যা প্রমাণ করে, ভূগোল যত দূরেই থাকুক, আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বাস কখনো হারিয়ে যায় না। এই পূজা কেবল দেবীর আরাধনা নয়, বরং এক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, সংহতি ও আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধার। ফরাসি প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে হিন্দু সংস্কৃতির এই বিচিত্র চর্চা এক নিঃসন্দেহে বিশ্বায়নের একটি মানবিক রূপ।
ছবি: সংগৃহীত