পিয়া রায়
আজ কৌশিকী অমাবস্যা। হিন্দু সাধনা-পরম্পরায় এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র অমাবস্যা তিথির মধ্যে কৌশিকী অমাবস্যা বিশেষভাবে তান্ত্রিক সাধনা ও শক্তি আরাধনার দিন হিসেবে পরিচিত। পুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, দেবী শক্তির নানা রূপ আজকের দিনে সাধকদের কাছে বিশেষভাবে প্রকাশিত হন। তাই বহু সাধক এই তিথিকে সিদ্ধিলাভের শ্রেষ্ঠ সুযোগ হিসেবে বেছে নেন।
এই দিনটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে তারাপীঠের নাম। বীরভূমের তারাপীঠ, যা দেবী তারা আরাধনায় ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান পীঠক্ষেত্র। এখানে অবস্থিত মহাশ্মশান—যা শুধু দাহস্থল নয়, বরং বহু যুগ ধরে তান্ত্রিক সাধনার পীঠভূমি। অগ্নিগর্ভ এই শ্মশানেই সাধকরা মৃত্যুকে জয় করার সংকল্প নিয়ে সাধনায় নিমগ্ন হন। সাধারণের কাছে ভয়ঙ্কর হলেও সাধকদের কাছে শ্মশানই শক্তির কেন্দ্র, যেখানে মায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে চরম সত্যের সাক্ষাৎ।
সেই মহাশ্মশানেই সাধক বামাক্ষ্যাপা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ১৯ শতকের এই মহান তান্ত্রিক সাধক জন্মেছিলেন বীরভূমেই। শৈশব থেকেই ভক্তি ও ভিন্নস্বভাব তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল। মানুষের প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানকে উপেক্ষা করে তিনি সরল মনে দেবী আরাধনায় মগ্ন হতেন। তাঁকে একদিকে সমাজ ‘পাগল বামা’ বলত, অন্যদিকে ভক্তরা তাঁকে দেখতেন মা তারার অন্যতম প্রিয় সন্তান হিসেবে।
কথিত আছে, কৌশিকী অমাবস্যার রাতে বামাক্ষ্যাপা মহাশ্মশানে তন্ত্রসাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। তখনই দেবী তাঁকে সরাসরি দর্শন দেন এবং তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। এই সিদ্ধির পর তাঁর মধ্যে অলৌকিক শক্তির প্রকাশ ঘটে—যা দিয়ে তিনি ভক্তদের নানা সমস্যার সমাধান দিতেন, রোগমুক্তি ঘটাতেন এবং মানুষের কষ্ট দূর করতেন। তাঁর জীবনের এই অধ্যায় তাঁকে শুধু সাধকই নয়, এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
আজও তারাপীঠে কৌশিকী অমাবস্যা ঘিরে হাজারো ভক্তের সমাগম ঘটে। মহাশ্মশানে চলে সারারাতব্যাপী হোমযজ্ঞ, তন্ত্রসাধনা ও দেবী তারার পূজা। বহু সাধক বিশ্বাস করেন, এই রাতে মা তারা বিশেষভাবে জাগ্রত হন এবং ভক্তদের সাধনা গ্রহণ করেন। তাই এই অমাবস্যা শুধু পূজারীতি নয়, ভক্তদের কাছে শক্তি, ভক্তি ও মুক্তির সন্ধিক্ষণ।
কৌশিকী অমাবস্যার মাহাত্ম্য এবং বামাক্ষ্যাপার সিদ্ধিলাভের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভক্তির শক্তি ও আত্মসমর্পণই যে কোনো সাধকের পরম প্রাপ্তি এনে দিতে পারে। আজকের দিন তাই শুধু আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নয়, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবেও অসীম মূল্যবান।