পিয়া রায়
প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে আমরা অনেক কিছুই শুনি—গাড়ির হর্ন, মানুষের চিৎকার, বিজ্ঞাপনের সুরেলা আহ্বান কিংবা মোবাইলের রিংটোন। কিন্তু সত্যিকারের শোনা, মন দিয়ে, সহানুভূতির সঙ্গে, উপলব্ধির সঙ্গে—সে অভ্যাস যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই মূল্যবান অভ্যাসের গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দিতেই প্রতিবছর ১৮ জুলাই পালিত হয় World Listening Day।
শোনা একটি কৌশল, একটি শিল্প, এবং অনেকসময় একধরনের নিরব যোগাযোগ। এই দিনটির পেছনে রয়েছে কানাডিয়ান কম্পোজার ও পরিবেশ সচেতনতা গবেষক রেমন্ড মারি শেফার। তিনি ছিলেন ‘soundscape ecology’-র জনক, যিনি শব্দের পরিবেশগত প্রভাব ও মানুষের শ্রবণ অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করেছিলেন। World Listening Day হল তাঁর চিন্তাভাবনা ও কাজকে সম্মান জানানো এবং বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরির প্রয়াস।
আজকের দিনে আমরা কেবল শব্দ শুনি না, বরং প্রকৃতি কী বলছে—তা বোঝার চেষ্টা করি। নদীর কলকল ধ্বনি, পাখির ডাক, পাতার মর্মর—এসবের মাঝে প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু এই শব্দগুলো ক্রমশ নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে, কারণ মানুষের শোরগোল, যন্ত্রের গর্জন, এবং নগরায়নের অসহনীয় কোলাহল প্রকৃতির নিজস্ব ভাষাকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে। World Listening Day-র উদ্দেশ্য হলো এই শব্দ দূষণের প্রভাব নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং ধ্বনি-ভিত্তিক পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা।
তবে শুধু প্রকৃতির কথা নয়, আজকের দিনে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত মানুষকেও। একটি সহানুভূতিশীল কান অনেক সময় একজন ভাঙা মনের ওষুধ হয়ে উঠতে পারে। আমরা সবাই বলতে ভালোবাসি, কিন্তু শুনতে ভালোবাসি এমন মানুষ বিরল। অথচ একজন ভালো শ্রোতা হওয়া মানে হল সম্পর্ক গড়ে তোলা, বোঝাপড়া বাড়ানো এবং সহানুভূতির সঙ্গে একজন মানুষকে জায়গা করে দেওয়া।
শ্রবণ কেবল একতরফা কাজ নয়; এটি মানসিক উপস্থিতি এবং সম্মান প্রদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। শিশুরা যখন কথা বলে, প্রবীণরা যখন স্মৃতি বলেন, কিংবা কোনো বিপর্যস্ত মানুষ যখন সাহায্য চায়—তখন তাদের শোনা মানে তাদের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া। আজকের দিনে আমরা যদি একটু মন দিয়ে শুনি, তাহলে অনেক ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগতে পারে, অনেক ভুল বোঝাবুঝি মিটে যেতে পারে।
World Listening Day আমাদের শেখায়—নীরবতা শুধু শূন্যতা নয়, বরং সেই জায়গা যেখানে শব্দ তার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায়। শব্দের পেছনে যে গল্প, যে আবেগ, যে বেদনা বা আনন্দ লুকিয়ে থাকে, তা বোঝার চাবিকাঠি হল মনোযোগী শ্রবণ। তাই আসুন, শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো শুনি—নিসর্গের, মানুষের, সমাজের এবং হৃদয়ের। শ্রবণের মাধ্যমে আমরা আরও বেশি মানবিক হতে পারি।


