যোগমায়া আচার্য
বিশ্ব জুড়ে যখন আমরা সভ্যতার জয়গান গাই, তখনই মানব পাচারের মতো এক অন্ধকার অধ্যায় মানবতার লজ্জা হয়ে রয়ে গেছে। প্রতিবছর ৩০ জুলাই পালিত হয় World Day Against Trafficking in Persons—একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দিন যা আমাদের সচেতন করে তোলে এই ভয়ঙ্কর অপরাধের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ ২০১৩ সালে এই দিনটি ঘোষণা করে মানব পাচারের ভয়াবহতা তুলে ধরার এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়াস নেয়।
মানব পাচার মানে কেবল দেহ বেচাকেনা নয়, এটি এক ভয়ঙ্কর আধুনিক দাসত্ব, যেখানে মানুষকে শোষণের জন্য অপহরণ, প্রতারণা, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নিপীড়ন, শিশু পাচার এমনকি অঙ্গ চোরাচালানের মতো ভয়ানক কাজে ঠেলে দেওয়া হয়। সবচেয়ে করুণ বিষয় হলো, এই অপরাধের শিকার হয় সমাজের দুর্বল, দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষ—বিশেষ করে নারী ও শিশু।
বর্তমানে বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানব পাচারের শিকার। উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত দেশেও এই অপরাধের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। পাচারকারীরা প্রযুক্তি, ভুয়ো চাকরির প্রতিশ্রুতি, বিদেশে ভালো জীবনের স্বপ্ন ইত্যাদি ব্যবহার করে মানুষকে ফাঁদে ফেলে। এই অপরাধ নিছক ব্যক্তিগত নয়, এটি এখন আন্তর্জাতিক চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক সংঘবদ্ধ অপরাধ, যার শিকড় বিস্তৃত বহু দেশে।
এই দিনে আমাদের করণীয় একাধিক। প্রথমত, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। অনেকেই জানেন না কীভাবে এবং কখন মানব পাচারের শিকার হতে পারেন তারা। দ্বিতীয়ত, সরকার ও প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে—সীমান্তে নজরদারি, পাচার চক্র ভাঙা, দ্রুত বিচার এবং শিকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, আমাদের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব সমাজের যে কোনও সন্দেহজনক কার্যকলাপ সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ ও সহায়তা করা।
মানব পাচারের বিরুদ্ধে এই লড়াই শুধু আইন বা প্রশাসনের নয়, এটি এক একটি মানুষের বিবেকের যুদ্ধ। একবার শিকারে পরিণত হলে, বহু মানুষ আর আগের জীবনে ফিরতে পারেন না। তাই প্রতিরোধই হোক প্রাধান্য। শিশুদের শিক্ষা, নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা, সামাজিক সুরক্ষা—এসবই মানব পাচার রুখতে বড় অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
৩০ জুলাই শুধুমাত্র একটি আন্তর্জাতিক দিবস নয়, এটি যেন মানবতার আহ্বান হয়ে ওঠে—আর একটি মানুষও যেন না পড়ে এই অমানবিক শৃঙ্খলের ফাঁদে। আসুন, আমরা সকলে মিলে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই, প্রতিবাদ করি, সচেতন হই এবং এই লজ্জাজনক অধ্যায়ের ইতি টানতে সক্রিয় ভূমিকা নিই। কারণ প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার নিয়ে জন্মায়—সেই অধিকার রক্ষা করাই আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব।