Select language to read news in your own language

টোটো চালিয়ে জীবন, চিকিৎসায় থেমে স্বপ্ন


আর বিপ্লব

 

দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট, একটি শহর যেখানে প্রতিদিনের জীবনযাত্রা এগিয়ে চলে হাজারো অটো ও টোটোর চাকার ঘূর্ণনে। এই শহরের একটি বড় অংশের অর্থনীতি নির্ভর করে অটো বা টোটো চালানোর উপর। শহরের গলি থেকে প্রধান রাস্তা—সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই যানবাহনগুলোর চালকরাই এখানে একপ্রকার নীরব রোজগারযোদ্ধা। তাদের প্রতিদিনের আয় সাধারণত যথেষ্ট হয় একটি গড়পড়তা সংসার ভালোভাবে চালানোর জন্য। তবে এই সচ্ছলতা বড়ই নাজুক। একটু রোগবালাই বা শারীরিক সমস্যাই তা মুহূর্তে ভেঙে দিতে পারে।

কারণ, এই শহরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল এতটাই বেহাল যে, সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য গেলেও মানুষ পাচ্ছে না ঠিকমতো সেবা। সময়মতো চিকিৎসা না হওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতি, পরিকাঠামোর দুর্বলতা—সব মিলিয়ে এক গভীর অনাস্থা তৈরি হয়েছে জনমানসে।

একজন টোটোচালক জানালেন, “সারাদিন টোটো চালিয়ে ভালোই রোজগার হয়। শহরের সাধারণ মানুষ ও পর্যটকদের জন্য কাজের অভাব হয় না। সংসার ভালোই চলে। কিন্তু শরীর খারাপ হলে বড় সমস্যা। সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা ঠিকমতো হয় না। তখন বাধ্য হয়ে প্রাইভেটে যেতে হয়। আর সেখানেই শেষ হয় সব সঞ্চয়।”

==========

সাতসকাল’ ই-খবরের কাগজ আবার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। অনুগ্রহ করে ফেসবুক পেজটি লাইক করুন এবং ইনবক্সে আপনার মূল্যবান পরামর্শ ও মতামত জানান।

========== 

এই অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র তার একার নয়। প্রায় একই অভিজ্ঞতা শোনালেন আরেকজন টোটোচালক, যিনি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও বললেন, “বাচ্চা ছেলেটার জ্বর হয়েছিল। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে ডাক্তারই ছিল না। পরে নার্স বলল, ওষুধ শেষ। এত ভয় পেলাম যে ছেলেকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাই। খরচ এমন জায়গায় পৌঁছল যে এক সপ্তাহ টোটো চালানোই বন্ধ রাখতে হয়েছিল।”

এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছে একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা—যেখানে দিনের শেষে কিছুটা আয় করে যে পরিবারগুলো মাথা উঁচু করে জীবনযাপন করে, তারা রাতারাতি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবে।

এই বিষয়টিকে আরও গভীরভাবে অনুধাবন করিয়ে দিলেন বালুরঘাটের আরেক জনৈক টোটোচালক ভগীরথ। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তিনি জানালেন, “সাধারণ পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে যাই। সেখানে দ্রুত চিকিৎসা না হওয়ায় প্রাইভেট হাসপাতালে যাই। তাতেই শেষ হল আমার কয়েক মাসের সঞ্চয়। এখন শরীর খারাপ হলেই ভয় হয়, কারণ জানি—সরকারি জায়গায় ভরসা নেই, আর প্রাইভেট জায়গায় চিকিৎসা করানোর টাকা নেই।”

এই ভয়ের মূলে রয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগের দীর্ঘদিনের উদাসীনতা। চিকিৎসক নেই, যন্ত্রপাতি অকেজো, জরুরি পরিষেবার বড্ড অভাব—সব মিলিয়ে যেন এক জর্জরিত ব্যবস্থা।

আরেকজন টোটোচালক বলেন, “আমরা ছোট লোক, বেশি আশা করি না। শুধু চাই, শরীর খারাপ হলে কম পয়সায় একটু চিকিৎসা পাবো। কিন্তু এখানে তো সেইটাও পাওয়া যায় না। সরকারি হাসপাতালে গেলে আমাদের বলেই দেয়—এখানে কিছু হবে না, প্রাইভেটে যান।”

এই পরিস্থিতিতে সারা বালুরঘাট জুড়ে অটো ও টোটোচালকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক অজানা আতঙ্ক। তারা বুঝে গেছেন, যতদিন শরীর ভালো, ততদিনই আয় আছে, সংসার আছে। কিন্তু যেই একদিন শরীর খারাপ হল, সেই দিন থেকেই শুরু হয় অর্থনৈতিক দুর্যোগ।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একাধিক পরিবার তাদের সন্তানদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খরচে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো কোনো পরিবার ধার করে চিকিৎসা করাচ্ছে, কেউ কেউ সোনা বন্ধক রেখে ওষুধ কিনছে।

অথচ বালুরঘাটের মতো একটি জেলার সদর শহরে এমন হওয়া উচিত ছিল না। এই শহরের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায়, তারা যদি সরকারি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তার দায় তো প্রশাসনের।

শুধু নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন সেই প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত করার সদিচ্ছা। প্রয়োজন সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ, ওষুধ ও জরুরি পরিষেবার সহজলভ্যতা, এবং স্থানীয় মানুষের প্রতি সংবেদনশীল মনোভাব।

আজ এই শহরের হাজার হাজার টোটোচালকের জীবনে ‘সচ্ছলতা’ শব্দটি শুধু আয় দিয়ে নির্ধারিত নয়। বরং সেই আয় দিয়ে স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায় কি না—সেই প্রশ্নই এখন মূল বিষয়।

এই শহরের মানুষের অভিজ্ঞতা যেন একটা নিঃশব্দ আর্তনাদ, যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এক সামাজিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত।

দিন শেষে যখন একজন টোটোচালক নিজের সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায় কোলে নিয়ে সরকারি হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন—তখন শহর জুড়ে যে অদৃশ্য বেদনার সুর বাজে, তার প্রতিধ্বনি যেন প্রশাসনের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না।

এই প্রতিধ্বনি যদি কখনো শোনা যায়, তবে হয়তো বালুরঘাটের মানুষ আবার বিশ্বাস করতে পারবে—সচ্ছলতা শুধু আয় নয়, একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনের নাম। ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon