পিয়া রায়
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ—পর্যটনের জন্য বিখ্যাত হলেও, এখানে ধর্মচর্চার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, শুধুমাত্র ইসলামই রাষ্ট্রধর্ম এবং মালদ্বীপের নাগরিক হওয়ার জন্য মুসলমান হওয়া বাধ্যতামূলক। এর ফলে হিন্দু ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের প্রকাশ্য অনুশীলন এখানে নিষিদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে, মালদ্বীপে দুর্গাপূজার মতো একটি উৎসব পালন করা কীভাবে সম্ভব হয়, সেটিই আলোচনা ও কৌতূহলের বিষয়।
মূলত ভারত, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আসা প্রবাসী শ্রমিক ও কর্মজীবীরা মালদ্বীপে বসবাস করেন এবং এঁদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তবে তাঁরা দেশের নাগরিক নন, কেবল অস্থায়ী বাসিন্দা বা কর্মজীবী। এই বিদেশি হিন্দুদের মাঝে দুর্গাপূজা পালনের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, আইনগত বাধা ও সামাজিক পরিসীমার কারণে তা একান্তই ব্যক্তিগত এবং সীমাবদ্ধ আকারে পালন করা হয়।
প্রকাশ্য মণ্ডপ, প্রতিমা বিসর্জন কিংবা মাইক ব্যবহার করে পূজার আয়োজন—এসব কিছুই মালদ্বীপে সম্ভব নয়। তবুও, ধর্মীয় অনুভূতির টান এত সহজে থেমে যায় না। তাই অনেক সময় ছোট রিসোর্ট বা আবাসিক ফ্ল্যাটে, খুবই গোপনীয় ও সীমিত পরিসরে দুর্গাপূজা হয়। এখানে পুজো মানে একটি মাটির প্রতিমা নয়, বরং কাগজে মুদ্রিত দেবীমূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালানো, স্তব পাঠ, এবং একটি নির্জন কিন্তু আন্তরিক সন্ধ্যা।
এইসব গোপন পূজার আয়োজকরা মূলত একে অপরের উপর নির্ভর করে, নিঃশব্দে উৎসব ভাগ করে নেন। দুর্গাপূজা এখানে উৎসবের বাহার নয়, বরং চুপচাপ বিশ্বাস ধরে রাখার লড়াই। ভক্তি এখানে নিঃশব্দে উচ্চারিত হয়, মন্ত্র নয়, মনঃসংযোগের মাধ্যমে। যারা ভারতে বা বাংলাদেশে পূজোর জাঁকজমক দেখে বড় হয়েছেন, তাঁদের কাছে এই অভিজ্ঞতা খুবই ভিন্ন। কিন্তু একইসঙ্গে এ এক গভীর, নিঃশব্দ আত্মিক সাধনা।
ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে মালদ্বীপের এই কঠোর অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলেও বহুবার সমালোচিত হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়টি তুলেছে। তবে সরকার এখনো তাদের অবস্থানে অনড়। ফলে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রবাসীরা ধর্মাচরণে আইনের সীমা অতিক্রম না করে নিজের বিশ্বাসটুকু যতদূর সম্ভব ধরে রাখেন।
মালদ্বীপে দুর্গাপূজা তাই এক ধরনের প্রতিকী অস্তিত্বের প্রকাশ—যেখানে উৎসব নেই, মেলা নেই, ঢাকের আওয়াজ নেই; কিন্তু আছে একরাশ নিঃশব্দ প্রার্থনা। এই প্রার্থনার মধ্যেই একদিকে আত্মপরিচয় টিকে থাকে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বের বৈচিত্র্যময় চিত্র ফুটে ওঠে।
অতএব, মালদ্বীপে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব প্রশ্নে হলেও, সেটি নিছক ধর্মীয় নয়; বরং মানবিক অনুভব, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের এক সংবেদনশীল সমীকরণ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পূজো শুধু মণ্ডপে নয়—বিশ্বাসে, অভ্যন্তরে, অন্তরাত্মায়ও হয়।
ছবি: সংগৃহীত