নরেন্দ্রনাথ কুলে
বেসরকারিকরণের সমর্থনে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি । রাজনীতিকরণের স্পর্শ ছাড়া শিক্ষা বেসরকারিকরণের পথে পা বাড়াতে পারে না । বর্তমানে তার চেহারা ক্রমশ দৃশ্যমান। শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা যত রাজনীতিকরণের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার চেষ্টা প্রকট হচ্ছে তত শিক্ষার মান পড়তে থাকে এবং পাশাপাশি দুর্নীতি বাড়তে থাকে । সেখানে শিক্ষার উন্নয়ন বলে যত বড়াই থাকুক । স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রে শাসকদলের নেতামন্ত্রী সর্বোচ্চ পদ থেকে কোনো না কোনো পদে আসীন । যার গালভরা সংলাপে বলা হয়, এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের লক্ষ্যে নাকি এমন ব্যবস্থা । এই উন্নয়নটা কি ? বাহ্যিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চকচকে কলেবর বৃদ্ধি হতে পারে, তাতে শিক্ষার মান বাড়ে কিনা তা যে বলা যায় না । শিক্ষার রাজনীতিকরণ শুধু এখনই নয়, এ দেশে কংগ্রেস থেকে সব শাসনেই তার কমবেশি প্রয়োগ হয়েছে । এই সময় তার যেন নির্লজ্জভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে । তাই স্বাধীন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে তদানীন্তন দেশসেবক ও শিক্ষাসেবক মানুষগণ যেভাবে ভেবেছিলেন তাঁদের সেই ভাবনা নিয়ে আজকের বিজ্ঞাপিত দেশসেবকরা আর ভাবেন না । যেমন নেতাজি বলেছিলেন, "ধর্মের নামে, দেশের নামে বা রাজনীতির নামে কোন প্রকার গোঁড়ামি যেন আমাদের শিক্ষামন্দিরে প্রবেশ করিতে না পারে, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি রাখা উচিত ।" কিন্তু নেতাজির এই ভাবনা থেকে আমাদের দৃষ্টি-যে একেবারে নেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । আবার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন- "বিশ্ববিদ্যালয় কোন কোন বিষয় পড়াবেন এবং কোন পদ্ধতিতে পড়াবে ও গবেষণা করবে, সে ব্যাপারে অবশ্যই বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে । আমাদের একে একইভাবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে রাজনৈতিক বাধা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পুরোহিততন্ত্রের বাধা---সমস্ত দিক থেকে মুক্ত রাখতে হবে ..।" কিন্তু আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এই সমস্ত দিক থেকে মুক্ত করার প্রয়াস ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে পড়েছে । তাছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রমশঃ সরকারের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত । যা 1986 সালে রাজীব গান্ধী সরকারের ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর থেকেই তা দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের এ পর্যন্ত সব সরকারই । শিক্ষার বেসরকারিকরণের পাশাপাশি শিক্ষার রাজনীতিকরণ নিয়ে আজকে আর কোন গোপনীয়তা নেই । তাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল না মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে তর্ক বেশ স্বাভাবিক । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় শিক্ষাবিদ থাকলে হয়তো শিক্ষার মান থাকে না । তাই হয়তো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের (বিশেষত শাসক দলের) শিক্ষাক্ষেত্রের মাথায় বসাতে আইনে কোনো বাধা থাকে না । আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকবে আর তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না তা তো হতে পারে না । আর সেই প্রভাবে সরকারি ক্ষমতার প্রতিফলন অবশ্যই-যে থাকে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না । বিশিষ্ট দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, "এটা কোনো মতে সহ্য করা যায় না যে, একটি সরকার তার সরকারি ক্ষমতাবলে বা অন্য কোনভাবে জনসাধারণের শিক্ষার উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখবে । এই ধরনের ক্ষমতা থাকলে বা বাস্তবে তাকে প্রয়োগ করলে তা স্বৈরতান্ত্রিক হতে বাধ্য । যে সরকার জনসাধারণের মতামত ও আবেগকে ছোটবেলা থেকে পরবর্তী জীবন পর্যন্ত নিজেদের মত করে গড়ে তুলতে পারে সেই সরকার তাদেরকে দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে ।" তাহলে আজকে শিক্ষার রাজনীতিকরণে জন মিলের কথার প্রাসঙ্গিকতা এখনো শেষ হয়ে যায় নি । আর সেই প্রাসঙ্গিকতায় শিক্ষা ও শিক্ষাক্ষেত্র বেসরকারিকরণ আর রাজনীতিকরণে-যে তার মান উন্নত হতে পারে না তার নিদর্শন আজ সর্বোত্র প্রকাশমান ।