আর বিপ্লব
দেশপ্রেম ও দেশরক্ষা – এই দুই শব্দে গড়ে ওঠে একটি দেশের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়। ভারতবর্ষ যেমন সাহসিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে সেনা, বিজ্ঞান ও নাগরিক চেতনার মাধ্যমে, তেমনি কিছু রাজনৈতিক দল এই আত্মপরিচয়কে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেই তালিকায় অন্যতম হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী), অর্থাৎ সিপিআই(এম)। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই দলের চিন্তাভাবনা, আন্তর্জাতিক আনুগত্য, নিরাপত্তা ইস্যুতে বক্তব্য এবং দেশরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অবস্থান বারবার সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তা ও বিভ্রান্তি
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যখন গোটা দেশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল, তখন কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান ছিল দ্ব্যর্থক। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় সিপিআই ব্রিটিশদের বিরোধিতা করেনি। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সঙ্গে ছিল এবং সিপিআই সেই সময় সোভিয়েত অনুগামী ছিল। এ এক ভয়াবহ পরিহাস—একদিকে সারা ভারত যখন স্বাধীনতার জন্য আত্মদান করছিল, তখন লাল পতাকাধারীরা বিদেশি শক্তির নির্দেশে দেশীয় সংগ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।
চীন-ভারত যুদ্ধ: কার পক্ষে ছিলেন বামপন্থীরা?
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় সিপিআই-এর একটি বড় অংশ ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। চীনের আগ্রাসন যখন স্পষ্ট, তখনও দলের অনেক নেতা চীনের পক্ষে বিবৃতি দেন। তারা এই আগ্রাসনের জন্য ভারতীয় নেতৃত্বকে দায়ী করে এবং চীনের ‘সাম্যবাদী নীতি’কে ন্যায়সঙ্গত বলে ব্যাখ্যা করতে থাকেন। প্রশ্ন ওঠে—যারা দেশের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ, বরং শত্রুর যুক্তিকে সঙ্গত মনে করে, তারা কিভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে?
জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং বামপন্থীদের ‘বিরোধিতার নীতি’
সিপিআই(এম) বরাবরই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় নয়, বরং স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দই রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব। যদিও এই যুক্তি আংশিকভাবে মানবিক মনে হলেও, বাস্তবতা হলো—জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি সবকিছুই ঝুঁকির মুখে পড়ে। কিন্তু সিপিআই(এম) কখনোই এই বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেয়নি। তারা যুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা কার্যত প্রতিরক্ষা-দুর্বলতা তৈরি করেছে।
সেনাবাহিনীর মনোবল ভাঙা বক্তব্য
বাম নেতৃত্ব বহুবার সেনাবাহিনীকে ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রেখেছেন। তারা সেনাবাহিনীর অভিযানে সন্দেহ প্রকাশ করেন, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতিকে ‘বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদ’ বলে আখ্যা দেন। 2016 সালের সার্জিকাল স্ট্রাইক বা 2019 সালের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের সময় বাম নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল চরম নেতিবাচক। কোনো প্রশংসা ছিল না, বরং ছিল প্রশ্ন—"এই অভিযান কি সত্যিই হয়েছিল?" এই মনোভাব শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়, এটি একধরনের মানসিক বিচ্ছিন্নতাও, যা জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি দায়হীনতার পরিচয়।
'দেশপ্রেম' শব্দের প্রতি অবজ্ঞা
বামপন্থী মতাদর্শে ‘দেশপ্রেম’ শব্দটি বরাবরই বিতর্কিত। তাদের দৃষ্টিতে দেশপ্রেম যেন একধরনের দক্ষিণপন্থী আবেগ, যা বহুজাতিক শ্রমিক আন্দোলনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা দেশপ্রেমকে ‘বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ’ বলে এড়িয়ে যেতে চায়। অথচ বাস্তবতা হলো, শ্রমিকের অধিকার হোক বা কৃষকের মুক্তি—সবই সম্ভব তখনই, যখন একটি দেশের সুরক্ষা ও অখণ্ডতা নিশ্চিত হয়। বাম রাজনীতির এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈততা আজ তাদের জনগণের কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে
কাশ্মীর নিয়ে দ্ব্যর্থক বক্তব্য
৩৭০ ধারা বাতিলের সময় সিপিআই(এম) প্রথম সারিতে থেকে বিরোধিতা করে। তারা এই পদক্ষেপকে ‘সংবিধান লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দেয়, অথচ দেশের বৃহত্তর স্বার্থ, জাতীয় ঐক্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি তারা একেবারেই বিবেচনায় আনেনি। বরং জেহাদপন্থী গোষ্ঠীর বক্তব্যের সুরে সুর মিলিয়ে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। কাশ্মীরের নিরীহ জনগণের উপর পাক-প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের অত্যাচার যখন চলছিল, তখন সিপিআই(এম) কখনও সরব হয়নি। এই নীরবতা কি কৌশলগত, না আদর্শগত—এ প্রশ্ন থেকে যায়।
আন্তর্জাতিক স্তরে বিভ্রান্তিকর অবস্থান
বামপন্থী দলগুলোর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বরাবরই বিতর্কিত। চীন, উত্তর কোরিয়া বা ভেনেজুয়েলার মতো একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতি তাদের একধরনের নরম মনোভাব, এবং পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রতি নিগ্রহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকে বিব্রত করেছে। তারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকসময়ই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এমন ভাষা ব্যবহার করেছে, যা দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
সীমান্তে চীনা আগ্রাসনের সময় চুপচাপ ভূমিকা
২০২০ সালে গালওয়ান সংঘর্ষের সময়, যখন দেশজুড়ে চীনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উথলে উঠেছিল, তখন সিপিআই(এম) চুপচাপ থেকেছে। সেনার প্রতি সরাসরি সমর্থন বা সরকারকে কৌশলগতভাবে জোরদার করার বদলে তারা বারবার শান্তির কথা বলেছে, চীনের নাম এড়িয়ে গেছে, এমনকি কিছু অংশে দুই পক্ষকেই দায়ী করে ‘যুদ্ধবিরোধী’ কথাবার্তা বলেছে। অথচ ভারতের সার্বভৌমত্ব ছিল প্রশ্নের মুখে—এই সংকটময় মুহূর্তে তাদের নির্লিপ্ত অবস্থান জাতীয় দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
একটি দেশের প্রকৃত শক্তি তার সেনাবাহিনী, তার জনগণের দেশপ্রেম এবং তার নেতৃত্বের দৃঢ়তায় নিহিত। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বারবার এমন অবস্থান নিয়েছে, যা দেশপ্রেমের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান সীমান্ত সঙ্কট পর্যন্ত—সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্টভাবে দেখায়, তারা আদর্শের নামে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাহ্য করেছে।
বামপন্থী রাজনীতি এক সময় জনআন্দোলনের প্রতীক ছিল, কিন্তু আজ তা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একদল চিন্তাশীল আদর্শবাদীর ক্লান্ত বৃত্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা দেশপ্রেমকে প্রশ্ন করে, সেনাকে সন্দেহ করে এবং নিরাপত্তাকে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ মনে করে।
আজকের প্রজন্মের উচিত ইতিহাসের শিক্ষা নেওয়া—কে দেশরক্ষার প্রশ্নে নিঃস্বার্থ ছিল, আর কে আদর্শের মোহে পড়ে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে। কারণ দেশের জন্য আত্মত্যাগ একদিনে তৈরি হয় না, তা গড়ে ওঠে দায়িত্ব, সাহস এবং দেশপ্রেম দিয়ে—যা লাল পতাকার নিচে বহু বছর চাপা পড়ে ছিল।