রাজীব সিকদার
শ্রুতি কথার যুগ থেকে কলমের যুগ পেরিয়ে আমরা পদার্পণ করেছি স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার যুগে। এই পর্যায়ের মধ্যেই চলেছে মানুষের হৃদয়বৃত্তির নানান বহিঃপ্রকাশ। হৃদয়বৃত্তি প্রকাশের এই ক্ষেত্রগুলি মানুষের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও উৎপাদন ক্ষেত্র সহ ভাব বিনিময়ের বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে প্রসারিত। মানুষের অর্জিত জ্ঞানের জগৎ এই সকল ক্ষেত্রকেই জালের ন্যায় আবদ্ধ করে রেখেছে। একটা সাধারণ সুর সর্বত্রই প্রতিফলিত হয়। এই সুরটি হলো রক্ত মাংসের মানুষের মাতৃ বন্দনা, মাতৃ কামনা কিম্বা অসহায়ের ঈশ্বর বন্দনা। একটা রক্ত মাংসের জীবন্ত মানবিক সত্ত্বায় সারা জীবন এই আকাঙ্ক্ষা থাকেই। বাহ্যিক ভাবে তা প্রকাশিত হোক বা না হোক। কারো তা নজরে পড়ুক বা না পড়ুক । তবে এই মাতৃ সত্ত্বা স্ত্রী লিঙ্গের কোনো মানুষে আবদ্ধ নেই, তা আবদ্ধ হয়ে আছে মানব জগতের সকল কোমল ও সহনশীল অনুভূতির মধ্যে। তা সে নারী হোক বা পুরুষ। আবার ঈশ্বর সত্ত্বার বিষয়টিও বিশেষ কোনো দেবদেবী বা মূর্তি বা ধর্মাচরণে আবদ্ধ নেই, আবদ্ধ হয়ে আছে জীবনের অসহায় মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষা বা অনুভূতিতে।
এই মাতৃ কামনা বা ঈশ্বর বন্দনা আসলে অসহায়ত্বের অনুভূতির আলাদা আলাদা প্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। মানুষ যখন প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় কিম্বা একদলের দ্বারা নিপীড়িত, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত , অবহেলিত হয় বা সমাজে নানান জ্বালা - যন্ত্রণা, সুখ - দুঃখ, আনন্দ, ব্যথা, বেদনার সম্মুখীন হয় তখনই এই অনুভূতিগুলো তাঁর মধ্যে ভাষার জন্ম দেয়। মনের মধ্যে, স্বপ্নে এই অনুভূতির উপস্থাপনা চলে। সে ভাবে, সে বিড়বিড় করে কথা বলে, সে ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নে চেঁচায় বা কথা বলে, আবার সে মন খুলে কথা বলে, কখনও বা লেখনীতে, নানান চিত্রকলা, কারুকার্য , ভাস্কর্যে তা ফুটিয়ে তোলে। সব মিলিয়ে সে সমাজে একটা ভাবের জন্ম দেয়। নানান কৌশলে হৃদয়ের একটা ক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই তো আসলে হৃদয়বৃত্তি । বুদ্ধি, দক্ষতা, কর্মকুশলতা ও অভিজ্ঞতা বাড়তে বাড়তে এই ধরনের নানান অনুভুতির বৃদ্ধি ঘটে। সাথে সাথে অনুভূতি উপস্থাপনার নিত্য নুতন উপায় মানুষ খুঁজে বার করে, প্রকাশ করে। উন্মোচিত করে সমাজ উদ্ভূত হৃদয়বৃত্তি প্রকাশের বিস্তৃত সামাজিক ক্ষেত্রকে।
বিশেষ কোনো সামাজিক পরিকল্পনাকে মানুষ যখন সকলের প্রয়োজনে বাস্তবায়িত করতে সম্মিলিত হয় তখনই প্রয়োজন হয় রাজনীতির। যা আসলে একটা সামাজিক ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে হৃদয়বৃত্তিরই দর্পণ হিসাবে কাজ করে। কিন্তু, রাজনৈতিক কাজে সম্মিলিত ভাবে অংশগ্রহণকারী মানুষগুলোর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পার্থক্য যত বাড়তে থাকে বিবেক ও মানবিক অনুভুতির তথা হৃদয়বৃত্তির তত ওঠানামা চলে। বিবেক ও অনুভূতির এই ওঠানামার প্রতিফলন ঘটে দৈনন্দিন ক্রিয়া, আচার আচরণে, মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহার ও মর্যাদা দানে। হৃদয় বৃত্তির অধিক ওঠানামা রাজনীতির আলাদা আলাদা ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। এর সাথে ক্ষমতা, অপ্রয়োজনীয় ভোগ, খবরদারী, আত্মতুষ্টি যোগ হলে এক সময় হৃদয়বৃত্তি শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দের মধ্যে কিম্বা প্রচার প্রপাগান্ডায় প্রতিফলিত হয়। হৃদয়ানুভূতিতে - মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহারে - মর্যাদা দানে আর তার প্রতিফলন থাকে না। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে আবার সেই রাজনীতি বা মানুষগুলোকে হৃদয়বৃত্তির উৎস ক্ষেত্র সেই কোমল ও সহনশীল মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পুনরায় সমাজে ফিরতে হয় সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ বর্জন করেই। মিশতে হয় সমাজের সকল ক্ষেত্রে যেখানে মানুষ কর্ম ও উৎপাদনের উদ্দেশ্যে একে অন্যকে জড়িয়ে আছে।আস্বাদন করতে হয় সকল স্তরের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের বিবেক ও মানবিক গুণাবলীর দিকগুলি। পর্যবেক্ষণ করতে হয় হৃদয়বৃত্তির সকল প্রতিফলন ক্ষেত্রগুলো ।

