রাজীব সিকদার
২০২৫ সালের হিসাবে, ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৪৬ কোটি থেকে ১৪৭.৪ কোটির মধ্যে। এরকম বিপুল জনসংখ্যা ও জনসম্পদের দেশে শুধুমাত্র প্রগতিশীল ও যুগোপযোগী চিন্তাকেই তুলে ধরে একটা দেশকে, দেশের মানুষকে উন্নততর জায়গায় নিয়ে যাবে এমন দৃষ্টান্তমূলক সংবাদমাধ্যম ভারতে আছে কি ? যেটা ইউরোপ, আমেরিকায় ছিল বা আছে। না, ভারতে নেই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যতক্ষণ না জনগণের থাপ্পড় খায় ততক্ষণ নিজেদের বদলায় না। স্বাধীনতার যুগেও ছিল, এখনো তাই অবস্থা। এখন তো একটা অলংকার পেয়েছে, ' গদি মিডিয়া' ।
একটা সত্য ও সুন্দরের সংবাদ যে দেশের মানুষের মনকে প্রগতির দিকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে এ বোধোদয় ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের হয়েছে কিনা নজরে তেমন পড়ে না। সংবাদ পরিবেশন দেখে মনে হয় শহরে নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে বসে দৈনন্দিন নিউজের প্লট তৈরি করা এবং সাধারণ মানুষের মননকে যেকোনো উপায়ে শাসক ও অপরাধ চক্রের সাথে জড়িয়ে রাখা এঁদের কাজ। একই সাথে জনতার মননকে আমলাতান্ত্রিক ঘেরাটোপে যুক্তিহীন সন্দেহ, বিদ্বেষ, কৌতূহল, ছ্যাবলামি, নোংরামি, ইতরামি ইত্যাদির মধ্যে আটকে রাখার যাবতীয় প্রচেষ্টায় ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম করে চলেছে। মধ্যে মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত লেখালেখি, সমাজ সচেতনতা মূলক প্রচার চলে। পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঁচ করে কিছু বাহবা পেতে খবরের পরিবেশন চলে। কিন্তু, এটাই কি যথেষ্ট ? নাকি, একটা দেশের নাগরিক সমাজ সংবাদমাধ্যমের কাছে আরো বড় কিছু আশা করে ?
ব্যক্তিগত স্তরে কিছু সংবাদিক হয়তো ব্যতিক্রম আছেন । কিন্তু, তাঁর সারা জীবনের কাজের হিসাব দেখলে হয়তো জীবনের খুব সামান্য একটা সময়ই তিনি সাংবাদিকতা পেশাকে যথার্থ মর্যাদা দিতে পেরেছেন। বাকি সময়টা বশংবদ হয়েই থাকতে হয়েছে। কিম্বা শাসকের লেজুড় বৃত্তিতে যোগ দিয়েছেন।
ভোটের ক্ষমতা আর পুঁজিবাদী মাফিয়া রাজের চক্র বদলালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ভোল বদলায়। আর জনতাকে ঘোল খাওয়ায়। অনেক ভালো সাংবাদিকও প্রচার মাধ্যম ব্যবস্থার খপ্পরে পড়ে সত্য - মিথ্যা মেশানো শয়তান আমলার মতো আচরণ করে।
আর বর্তমানে সাংবাদিক তৈরিটা যেন কোনো ব্যাপারই না। ছোটবেলায় 'সাংবাদিক' বা ' জার্নালিস্ট ' শব্দটা শুনলেই একটা কৌতূহল ও শ্রদ্ধা তৈরি হত। এখন কোনো অনুভূতিই তেমন আসে না। ভারতীয় প্রচার মাধ্যম সম্পর্কে ব্যক্তিগত উপলব্ধিটা এরকমই।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ২৩শে মার্চ ২০২৪ তারিখের সর্বশেষ প্রকাশনা এবং পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, ভারতে ৬টি জাতীয় দল, ৫৮টি রাজ্য দল এবং ২,৭৬৩টি অস্বীকৃত দল রয়েছে। অর্থাৎ এই দলগুলোর সাথে আছে বিপুল সংখ্যক মানুষ একথা সত্য। কিন্তু, কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত দল ও চকচকে মুখমণ্ডলের মধ্যে, কখনও স্পন্সরড ব্যক্তির মধ্যে , কখনো বাজার গরম রাখতে কিছু লড়াকু মানুষকে তাঁরা নজরে রাখে। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের অসহায় পরিস্থিতি বুঝে খানিকটা মায়াকান্না জুড়ে ত্রাতা সাজবার আবহাওয়া তৈরি করে। এই সব নিয়েই নানান কায়দায় ঋতুভিত্তিক বা রুটিন সংবাদ পরিবেশনের কাজ চলে । রুটিন মাফিক পাবলিক সাইকোলজি নিয়ন্ত্রণ করতে করতে নেতৃত্বকারী সাংবাদিকদের জীবন অতিবাহিত হয়। সার্বিক ভাবে দেশের মানুষ পরিবেশিত সংবাদ দেখে শুনে প্রগতির পথে কতটা এগিয়ে এলো বা যেকোনো সমস্যার সঠিক শেকড় কোথায় সেটাকে আড়াল করে ফেলে বা এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেতৃত্বকারী সাংবাদিকদের থাকে না।
শাসক আর সংবাদের খরিদ্দারকে সন্তুষ্ট করাই যেন ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের কাজ। ভারতবর্ষের যা জনসংখ্যা এবং অগণিত পেশাজীবি বিচক্ষণ মানুষ যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত, সরকারী অফিস, কলকারখানায় ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে ছেয়ে আছেন, জীবন যুদ্ধে যাঁরা সত্যিই অক্লান্ত সৈনিক, যাঁরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, সংবাদ মাধ্যম তাঁদের কাছে যায় না। যদি বা যায় তার উদ্দেশ্যও অত্যন্ত সংকীর্ণ। মানুষের কথা, তাঁদের অনুভূতি উপলব্ধির বদলে যেন মুখে বসিয়ে দেওয়ার জন্যই সংবাদ সংগ্রহের উদ্যোগ দেখায়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের এ অতি ন্যাক্কারজনক দিক। যা, সার্বিক ভাবে বর্তমান সমাজে সর্বত্রই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের একটা সমালোচনার বিষয় হিসাবে উঠে আসছে।

