বিয়ার ব্রাউন
অনুবাদ: পিয়া রায়
প্রকৃতি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই, যে জলে তৃষ্ণা মেটাই কিংবা যে খাদ্যে বেঁচে থাকি—সবকিছুর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে বন্যপ্রাণী। অথচ মানুষ সভ্যতার দৌড়ে যত এগিয়েছে, ততই ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে বনের বাসিন্দারা। জাতীয় বন্যপ্রাণী দিবস এই বাস্তবতাকে আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে এবং মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণীজগৎকে বাঁচানোই হলো মানবজাতির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
এই দিবসের উদ্দেশ্য কেবল সচেতনতা সৃষ্টি করা নয়, বরং আমাদের মানসিকতায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। আমরা প্রায়শই মনে করি বন্যপ্রাণী কেবল জঙ্গলে থাকে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। অথচ সত্য হলো, প্রতিটি প্রাণী প্রকৃতির চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঘ না থাকলে হরিণের সংখ্যা বাড়বে, হরিণ বেশি হলে বন উজাড় হবে, বন না থাকলে বৃষ্টি কমবে, আর বৃষ্টি কমলে আমাদের কৃষি ধ্বংস হবে। অর্থাৎ, এক প্রাণীর অস্তিত্ব আরেকটির জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাই বন্যপ্রাণীকে বাঁচানো মানে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎকে বাঁচানো।
ভারতের মতো একটি বিশাল দেশে বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র্য সত্যিই বিস্ময়কর। রাজস্থানের মরুভূমি থেকে শুরু করে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, হিমালয়ের তুষারঢাকা পাহাড় থেকে আন্দামানের গভীর জঙ্গল—প্রতিটি অঞ্চলেই লুকিয়ে আছে অসংখ্য অনন্য প্রাণীর বসবাস। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, এশিয়ান হাতি, একশৃঙ্গ গণ্ডার, সিংহ, চিতাবাঘ, ময়ূর, নীলগাই কিংবা হিমালয়ি মনাল—সবাই আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এরা শুধু আমাদের গর্ব নয়, এদের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে নিজেদের পরিচিতি লাভ করি।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সম্পদ আজ চরম হুমকির মুখে। বন উজাড়, শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যার চাপ ক্রমশ প্রাণীদের আবাসস্থল সংকুচিত করছে। মানুষ তার স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করছে, অথচ প্রাণীরা কোথাও যেতে পারছে না। একসময় যে বাঘের গর্জনে বন কেঁপে উঠত, আজ সেই বাঘ সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্তির পথে। একইভাবে হাতি, গণ্ডার কিংবা হরিণও বিপন্নতার তালিকায় ঢুকে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় বন্যপ্রাণী দিবস আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। এই দিনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বনদপ্তর এবং সামাজিক সংগঠন মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করে—প্রাণী বাঁচলে বন বাঁচবে, আর বন বাঁচলে জীবন বাঁচবে। শিশুদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা কর্মশালা ও প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়, যাতে আগামী প্রজন্ম ছোটবেলা থেকেই প্রাণী ও প্রকৃতির গুরুত্ব বুঝতে পারে।
তবে শুধু দিবস পালনের মধ্যেই কাজ সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, নদী-খাল দূষিত না করা, বনাঞ্চল ভাঙচুর না করা—এসব ছোট ছোট অভ্যাসও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি সরকারকেও আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিকার ও পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বন্যপ্রাণী রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সামাজিকভাবেও আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। প্রায়শই আমরা পাখি, খরগোশ বা অন্য ছোট প্রাণী ধরে খাঁচায় রাখি। এটি কেবল নিষ্ঠুরতা নয়, প্রকৃতির ভারসাম্যও নষ্ট করে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি প্রাণী তার প্রাকৃতিক পরিবেশেই সবচেয়ে সুখী। আমরা যদি সত্যিই তাদের ভালোবাসি, তবে তাদের স্বাধীনতাকেই সম্মান জানাতে হবে।
জাতীয় বন্যপ্রাণী দিবস আসলে আমাদের এক অঙ্গীকারের দিন—প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের অঙ্গীকার। আজকের শিশু যদি বাঘকে কেবল ছবিতে দেখে বড় হয়, তবে আগামী দিনের পৃথিবী হবে প্রাণহীন এক মরুভূমি। তাই এখনই সময় আমাদের জেগে ওঠার।
আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রকৃতিকে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। বনদেবী, নাগদেবতা কিংবা বাঘদেব—এসব বিশ্বাস আসলে ছিল প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার উপায়। আজকের বিজ্ঞানের যুগেও সেই শ্রদ্ধা সমান জরুরি। কারণ প্রযুক্তি দিয়ে আমরা হয়তো অনেক কিছু তৈরি করতে পারি, কিন্তু একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনতে পারি না।
জাতীয় বন্যপ্রাণী দিবস তাই কেবল একটি দিন নয়, এটি হলো এক শপথের প্রতীক—আমরা সবাই মিলে বন্যপ্রাণীর পাশে দাঁড়াবো, তাদের জীবন ও আবাসস্থল রক্ষা করব। কারণ বন্যপ্রাণী শুধু বন নয়, আমাদের পৃথিবীরও প্রাণ।