পিয়া রায়
ক্ষুধা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৈষম্য। যেখানে কেউ প্রতিদিন অঢেল খাবার নষ্ট করছে, সেখানে আরেক প্রান্তে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুবেলা ভাত জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ বৈপরীত্য আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করে—কেন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও ক্ষুধার যন্ত্রণা মুছতে পারিনি? জাতীয় খাদ্য ব্যাংক দিবস ঠিক এই প্রশ্নকেই সামনে আনে এবং মনে করিয়ে দেয়, খাদ্য শুধু বেঁচে থাকার উপকরণ নয়, এটি মানবাধিকারের অংশ।
খাদ্য ব্যাংক মূলত এমন এক উদ্যোগ যেখানে উদ্বৃত্ত বা অতিরিক্ত খাবার সংগ্রহ করে রাখা হয় এবং তা পৌঁছে দেওয়া হয় অভাবী মানুষের হাতে। এর উদ্দেশ্য একদিকে যেমন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে আহার তুলে দেওয়া, অন্যদিকে খাদ্যের অপচয় রোধ করা। কারণ, প্রতিবছর পৃথিবীতে কোটি কোটি টন খাবার নষ্ট হয়, অথচ একই সময়ে লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। খাদ্য ব্যাংক এই অমানবিক ব্যবধান কমানোর প্রয়াস।
ভারতের মতো দেশে খাদ্য ব্যাংকের প্রয়োজন আরও গভীর। এখানে একদিকে কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি হলেও, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা এখনও বড় সামাজিক সমস্যা। শহরের হোটেল, বিয়ে বা উৎসবে প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয়, তা যদি সঠিকভাবে খাদ্য ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়, তবে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক সামাজিক সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী দল এ উদ্যোগকে এগিয়ে নিচ্ছে। তারা অব্যবহৃত খাবার সংগ্রহ করে তা রাতের আঁধারেই গৃহহীন মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে।
জাতীয় খাদ্য ব্যাংক দিবস আমাদের শুধু দানশীলতার পাঠ দেয় না, শেখায় দায়িত্বশীলতারও। কারণ ক্ষুধা কেবল দারিদ্র্যের ফল নয়, এটি সমাজের বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি সত্যিই সমতার সমাজ চাই, তবে ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেওয়াই হবে প্রথম পদক্ষেপ। এখানে ছোট অবদানও বড় পরিবর্তন আনতে পারে। একজন যদি প্রতিদিন অল্প খাবার দান করেন, তবে তা মিলিয়ে অনেক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব।
এই উদ্যোগে প্রযুক্তিও নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। আজ বিভিন্ন অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই অতিরিক্ত খাবার দান করতে পারছে। সংস্থাগুলো সেই খাবার সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট এলাকায় বিতরণ করছে। এতে যেমন অপচয় কমছে, তেমনি ক্ষুধার কষ্ট লাঘব হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাও সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে খাদ্য ব্যাংক কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে।
তবে খাদ্য ব্যাংক কেবল একদিনের নয়, এটি হওয়া উচিত আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস। খাবার নষ্ট না করা, অতিরিক্ত খাবার দান করা এবং ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া—এগুলো আমাদের নৈতিক কর্তব্য। কারণ, পৃথিবীতে কারও অভুক্ত থাকা কেবল তার ব্যর্থতা নয়, আমাদের সবার ব্যর্থতা।
জাতীয় খাদ্য ব্যাংক দিবস তাই শুধু খাদ্য দানের দিন নয়, এটি মানবিক সহমর্মিতার দিন। ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে আমাদের প্রত্যেককেই ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এক প্লেট খাবার হয়তো আমাদের কাছে তুচ্ছ, কিন্তু কারও কাছে সেটিই জীবন বাঁচানোর শেষ আশা।