আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসন এক অনন্য অধ্যায়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে এবং প্রথম দুই দশক মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটায়। ‘অপারেশন বর্গা’ ও ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের হাতে জমির অধিকার তুলে দেওয়া, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ঘটানো—এসব সাফল্য তাদের জনপ্রিয়তা দৃঢ় করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সাফল্যের ধার কমে যায়, শাসনে স্থবিরতা দেখা দেয়, এবং শেষপর্যন্ত ২০১১ সালে মানুষ ভোটের মাধ্যমে বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একাধিক কারণ এই পতনের ভিত্তি তৈরি করে।
প্রথমত, টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে বামফ্রন্টের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি জন্ম নেয়। প্রশাসন ও দলীয় কাঠামোয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রাথমিক তাগিদ ক্রমে শিথিল হয়। অনেক জায়গায় জনসংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং নেতারা জনগণের দৈনন্দিন সমস্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেন। এই দূরত্বই মানুষের মধ্যে “পরিবর্তন” চাওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।
দ্বিতীয়ত, শিল্প ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বাম শাসনের বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিকবান্ধব নীতি এবং ট্রেড ইউনিয়নের শক্ত অবস্থান একসময় শ্রমিক অধিকার রক্ষায় সহায়ক হলেও, পরবর্তী সময়ে এটি বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নতুন শিল্প স্থাপনের বদলে বহু পুরনো শিল্প বন্ধ হয়ে যায়, বেকারত্ব বেড়ে যায়, এবং রাজ্যের তরুণ প্রজন্ম কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাতে শুরু করে।
তৃতীয়ত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রাথমিক সাফল্যের পর মানের অবনতি মানুষের অসন্তোষ বাড়ায়। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তৃত হলেও গুণগত উন্নয়ন তেমন হয়নি। উচ্চশিক্ষা ক্রমশ দলীয় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে যায়, যার ফলে মেধা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি পরিকাঠামো দুর্বল হয় এবং সাধারণ মানুষকে বেসরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা তাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়।
চতুর্থত, কৃষি খাতে প্রথম দিকে ভূমি সংস্কার বিশাল সাফল্য বয়ে আনলেও, তার পরবর্তী সময়ে কৃষি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের অভাব দেখা দেয়। প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় কৃষকদের আয় বাড়েনি, বরং অনেকেই বিকল্প জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে।
পঞ্চমত, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন বামফ্রন্টের পতনের গতি ত্বরান্বিত করে। শিল্পায়নের প্রয়াসে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের কড়াকড়ি, পুলিশি অভিযান এবং গ্রামীণ অসন্তোষ চরমে পৌঁছায়। বামফ্রন্ট, যারা একসময় কৃষকদের রক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই চিত্র ভেঙে পড়ে এবং গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্কে বড় ভাঙন ধরে।
ষষ্ঠত, দীর্ঘ শাসনের ফলে দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি ও তদবির সংস্কৃতি বেড়ে যায়। অনেক জায়গায় দল ও প্রশাসন এতটাই একাকার হয়ে যায় যে, মানুষের অভিযোগ শোনার নিরপেক্ষ মঞ্চ হারিয়ে যায়। এতে বিরোধী শক্তি সহজেই জনসমর্থন পায়।
সপ্তমত, তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান বামফ্রন্টের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত নয়, গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের মধ্যেও আস্থা অর্জন করেন। তিনি সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, বামবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন, এবং পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিরোধী ভোটকে একত্রিত করতে সক্ষম হন।
অষ্টমত, তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ বাম রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। নতুন প্রজন্ম আধুনিক প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সংযুক্ত উন্নয়ন চেয়েছিল। তারা মনে করেছিল বামফ্রন্টের নীতি সময়োপযোগী নয় এবং পরিবর্তন ছাড়া নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে না।
সবশেষে, ৩৪ বছরের একদলীয় শাসনের পর ভোটারদের মধ্যে পরিবর্তনের চাহিদা তীব্র হয়ে ওঠে। “পরিবর্তন চাই” স্লোগান মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং ২০১১ সালের নির্বাচনে তারা সেই পরিবর্তন ঘটায়। এভাবে শাসনের শুরুর সাফল্য, মধ্যবর্তী সময়ে স্থবিরতা ও শেষ পর্যায়ে ভুল নীতি—সব মিলিয়ে বামফ্রন্টের ক্ষমতাচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের পতন তাই শুধু নির্বাচনী পরাজয় নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী শাসনের মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটের প্রতিফলন। এটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, জনগণ যে কোনো সময় শাসক বদলাতে প্রস্তুত, যদি তারা মনে করে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না।
