পিয়া রায়
যুক্তরাজ্যে দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালি সমাজের কাছে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম ভিত্তি। লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, এডিনবরার মতো বড় শহরগুলোতে প্রতিবছর দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন—যেমন London Durga Puja Committee বা Cambridge Ananda Mandir—যারা দীর্ঘদিন ধরে পূজাকে কেন্দ্র করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে লন্ডনের দুর্গাপুজো এখন ইউরোপের অন্যতম বড় পূজা হিসেবে পরিচিত, যেখানে ভারতীয় হাইকমিশনেরও সহযোগিতা থাকে।
যুক্তরাজ্যের দুর্গাপুজোয় প্রতিমা সাধারণত কলকাতা থেকে অর্ডার করে আনা হয়। মাটির প্রতিমা আনার ক্ষেত্রে পরিবহন জটিলতা থাকায় ফাইবারগ্লাসের প্রতিমাও ব্যবহৃত হয়, যা বছর বছর পুনর্ব্যবহারযোগ্য। ষষ্ঠীর বোধন থেকে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত পূজা প্রায় পুরোপুরিই কলকাতার ধাঁচে সম্পন্ন হয়। স্থানীয়ভাবে বসবাসরত পুরোহিত ছাড়াও অনেক সময় বিশেষ পুরোহিতকে ভারত থেকে আনা হয়। সকালে পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধ্যায় আরতি, ধুনুচি নাচ, শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনিতে লন্ডন কিংবা বার্মিংহামের পূজা মণ্ডপ মাতিয়ে তোলে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো ভোগ। যুক্তরাজ্যে পূজার সময় খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েস প্রভৃতি খাবারের আয়োজন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবকেরা রান্না করেন এবং শত শত মানুষ একসঙ্গে ভোগে অংশ নেন। এতে শুধু বাঙালিরাই নয়, স্থানীয় ব্রিটিশ নাগরিকরাও যোগ দেন। তারা ভারতীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেন এবং বাঙালি আতিথেয়তায় মুগ্ধ হন। এই ভোগের আয়োজন একদিকে যেমন ভক্তির প্রতীক, অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনেরও নিদর্শন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দুর্গাপুজোর আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ। রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক গান, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্যানুষ্ঠান—সবই অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ এই অনুষ্ঠানের মূল প্রাণ। তারা বাংলা গান গেয়ে বা নাচ পরিবেশন করে নিজেদের শেকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। একইসঙ্গে স্থানীয় ব্রিটিশ নাগরিক ও ইউরোপীয় দর্শকরাও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। অনেক সময় কলকাতা বা বাংলাদেশ থেকে জনপ্রিয় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা অনুষ্ঠানকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জন যুক্তরাজ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রতিমাগুলো সংরক্ষণ করা হয় বা প্রতীকী বিসর্জনের মাধ্যমে পূজার সমাপ্তি ঘটে। তবে সিঁদুরখেলা, বিজয়া সম্মিলনী এবং মিষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে পূজার আবহ পূর্ণতা পায়।
সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যের দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালিদের কাছে শুধু দেবী দুর্গার আরাধনা নয়, বরং এক মহামিলন উৎসব। এই ক’দিনের মধ্যে তারা আপনজনের সঙ্গে মিলিত হন, বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের আবহে ভেসে ওঠেন এবং মাতৃভূমির স্মৃতিকে নতুনভাবে ছুঁয়ে দেখেন। ব্রিটিশ মাটিতে থেকেও এই পূজা তাদের মনে করিয়ে দেয় যে দূরত্ব যতই হোক, সংস্কৃতির টান এবং ভক্তির আবেগ কখনও ম্লান হয় না।
ছবি: সংগৃহীত

