পিয়া রায়
জার্মানিতে দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালি সমাজের কাছে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে গভীর সংযোগ রক্ষার এক মহোৎসব। এখানে মূলত বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, মিউনিখ, হামবুর্গ, কোলনসহ বিভিন্ন শহরে দুর্গাপুজোর আয়োজন হয়ে থাকে। প্রতিটি শহরে স্থানীয় বাঙালি সংগঠন যেমন Berlin Puja Committee, Bengali Association Frankfurt বা Munich Durga Puja আয়োজন করে থাকে। প্রবাস জীবনের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ আয়োজন বছরের সবচেয়ে বড় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় পরিণত হয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, কমিউনিটি হল বা ভাড়া করা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিমাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফাইবারগ্লাস বা মাটির তৈরি, যেগুলো কলকাতা থেকে বিশেষভাবে এনে জার্মানিতে সাজানো হয়।
আচার-বিধির দিক থেকে জার্মানির দুর্গাপুজো পশ্চিমবঙ্গের নিয়মই অনুসরণ করে। ষষ্ঠীর বোধন থেকে শুরু করে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমীর পূজা সম্পূর্ণ বৈদিক নিয়মে অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় পুরোহিতের অভাব থাকায় অনেক সময় কলকাতা থেকে পুরোহিতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সকালবেলা পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধ্যায় আরতি এবং ধুনুচি নাচ—সবই ভক্তিভরে পালন করা হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ হলো ভোগ বিতরণ। খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েস—সবই স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে রান্না হয়ে যায় এবং শত শত মানুষ মিলেমিশে সেই ভোগ উপভোগ করেন। এই সমবেত ভোজন প্রবাস জীবনে একাত্মতা ও বন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দুর্গাপুজোর অপরিহার্য অংশ। স্থানীয় বাঙালি শিল্পীরা গান, নাচ, আবৃত্তি পরিবেশন করেন, আবার অনেক সময় কলকাতা থেকে নামকরা শিল্পীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তারা বাংলা গান, কবিতা, নাটক বা নাচে অংশ নিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয় এবং গড়ে তোলে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়। বার্লিন কিংবা ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো শহরে দর্শকরা শুধু প্রবাসী বাঙালিই নন, জার্মান নাগরিকরাও এই উৎসবে অংশ নেন। ভারতীয় খাবার, পোশাক, সংগীত এবং নাচ তাদের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। ফলে দুর্গাপুজো এখানে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সুযোগ না থাকায় প্রতিমাগুলো সাধারণত সংরক্ষণ করা হয় এবং পরবর্তী বছর আবার ব্যবহার করা হয়। তবে সিঁদুরখেলা, বিজয়ার প্রণাম ও মিষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। প্রবাসে থেকেও এই আচার বাঙালিদের মধ্যে গভীর আবেগ ও মাতৃভূমির স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
সব মিলিয়ে জার্মানিতে দুর্গাপুজো কেবল পূজা নয়, বরং প্রবাসী বাঙালির আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মহোৎসব। এটি প্রবাসীদের কাছে এক আত্মার টান, যেখানে ভক্তি, আনন্দ, নস্টালজিয়া ও মিলনমেলার আবহ একসঙ্গে মিশে যায়। এই কয়েক দিনের জন্য তারা যেন কলকাতার দুর্গাপুজোর সেই আনন্দময় পরিবেশকে নতুনভাবে জার্মান মাটিতে পুনর্নির্মাণ করেন।
ছবি: সংগৃহীত

