পিয়া রায়
ফ্রান্সে দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালি সমাজের জন্য এক অনন্য আবেগের উৎসব। এখানে মূলত প্যারিসসহ লিয়ঁ, মার্সেই, তুলুজ, স্ট্রাসবুর্গের মতো শহরে দুর্গাপুজোর আয়োজন দেখা যায়। ফরাসি মাটিতে বসবাসকারী ভারতীয় ও বাঙালি সম্প্রদায় এই উৎসবকে ঘিরে একত্রিত হন, আর এই মিলনমেলা হয়ে ওঠে শুধুই ধর্মীয় আচার নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বল প্রদর্শনী। প্যারিসের Paris Durga Puja Association বা Paris Bengali Association এর মতো সংগঠন প্রতিবছর দুর্গাপুজোর আয়োজন করে। সাধারণত স্থানীয় হল বা কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে দেবী দুর্গার প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিমা ফাইবারগ্লাস বা প্লাস্টারের তৈরি, যা ভারতে তৈরি করে এখানে আনা হয় অথবা ফ্রান্সেই স্থানীয় শিল্পীরা নির্মাণ করেন।
পুজোর সমস্ত আচার-বিধি নিয়মমাফিক পালিত হয়—মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত মন্ত্রপাঠ, পুষ্পাঞ্জলি, আরতি, ধুনুচি নাচ সবই অনুষ্ঠিত হয় যথাযোগ্য ভক্তিভাব নিয়ে। সপ্তমী থেকে নবমীর মধ্যে ভোগের আয়োজন প্রবাসী জীবনে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সাধারণত স্বেচ্ছাসেবকরা রান্না করে খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, টক-ঝাল চাটনি এবং পায়েস পরিবেশন করেন। এই সমবেত ভোজন কেবল ক্ষুধা মেটায় না, বরং উপস্থিত সবার মধ্যে একাত্মতার আবহ তৈরি করে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ। স্থানীয় বাঙালি শিল্পী ছাড়াও কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা গান, নাটক, নৃত্য পরিবেশন করেন। শিশু-কিশোরদের জন্য আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, গান ও নাচের আসর থাকে। এতে নতুন প্রজন্ম নিজেদের শিকড় ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিশেষত প্যারিসে প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় প্রবাসী বাঙালিরা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি এবং আধুনিক বাংলা গান দিয়ে উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন।
ফরাসি নাগরিকরাও এ উৎসবে অংশ নেন। অনেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি, সংগীত ও খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান দেখতে আসেন। এর ফলে দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে আন্তঃসংস্কৃতির বিনিময়ের ক্ষেত্র, যেখানে ভারতীয় ঐতিহ্য ফরাসি সমাজের সঙ্গে মিশে যায়। এই উৎসব কেবল বাঙালিদের নয়, ফরাসি সমাজের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ পরিচয় তুলে ধরে।
বিজয়া দশমীর দিনে এখানে প্রতিমা বিসর্জনের বদলে প্রতিমা সংরক্ষণ করা হয়। তবে সিঁদুরখেলা, বিজয়ার প্রণাম এবং মিষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। প্রবাস জীবনে ব্যস্ততার ভিড়ে দুর্গাপুজো কয়েকদিনের জন্য এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে, যেখানে সকলেই আপনজনের মতো মিশে যান।
ফলে বলা যায়, ফ্রান্সে দুর্গাপুজো কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং প্রবাসী বাঙালির জন্য আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গর্বের প্রতীক। এটি প্রবাসে থেকেও মাতৃভূমির সঙ্গে অটুট সম্পর্ক বজায় রাখার এক মহামঞ্চ, যেখানে আনন্দ, ভক্তি, নস্টালজিয়া আর মিলনমেলার আবহ এক হয়ে যায়।
ছবি: সংগৃহীত

