পিয়া রায়
সুইজারল্যান্ডে দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের কাছে এক অনন্য মিলনমেলা, যেখানে ধর্মীয় ভক্তি, সাংস্কৃতিক চেতনা এবং প্রবাসজীবনের টানাপোড়েন মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি করে। ইউরোপের এই দেশ মূলত তার সৌন্দর্য, শৃঙ্খলা ও বহুজাতিক সংস্কৃতির জন্য পরিচিত হলেও এখানকার প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায় বছরের অপেক্ষিত মুহূর্ত হিসেবে দুর্গাপূজাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। পূজার আয়োজন মূলত জুরিখ, জেনেভা ও বেসেলের মতো বড় শহরগুলোকে কেন্দ্র করে হয়। “Bengali Association of Switzerland” এবং আরও কিছু প্রবাসী সংগঠন পূজার দায়িত্ব পালন করে, যেখানে প্রবাসী ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা একসঙ্গে অংশ নেন।
প্রতি বছর শরৎকালে কোনো কমিউনিটি সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয় হল বা সাংস্কৃতিক ভেন্যুতে গড়ে ওঠে অস্থায়ী পূজামণ্ডপ। কলকাতা থেকে আনা প্রতিমা বা কখনও স্থানীয়ভাবে তৈরি প্রতিমা দিয়ে মহাষষ্ঠী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পুরোহিতকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, আবার অনেক সময় প্রবাসে বসবাসরত পুরোহিতরাই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রতিদিন সকালে অঞ্জলি, ভোগ আর সন্ধ্যায় আরতি ও ধুনুচি নাচ পূজার পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রবাসী বাঙালিরা নিজেরাই ভোগ রান্না করেন, যেখানে থাকে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি ও মিষ্টি। সেই ভোগের স্বাদ শুধু ধর্মীয় পরম্পরাই নয়, বরং বাঙালি ঐক্যের এক গভীর প্রতীক।
সুইজারল্যান্ডের দুর্গাপূজার অন্যতম আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রবাসী শিশু ও তরুণদের অংশগ্রহণে আবৃত্তি, নৃত্য ও গান পরিবেশিত হয়। কখনও কখনও কলকাতা বা ঢাকা থেকে শিল্পীরা আমন্ত্রিত হন, যা প্রবাসের পূজাকে বিশেষ মাত্রা দেয়। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবাসের দ্বিতীয় প্রজন্মও বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয় এবং নিজের শিকড়কে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সুইস নাগরিকরাও এই উৎসবে যোগ দেন। তারা প্রতিমা দর্শন করেন, ভোগের স্বাদ নেন এবং প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে উৎসব ভাগ করে নেন। এতে দুটি সংস্কৃতির মধ্যে একটি উষ্ণ যোগসূত্র তৈরি হয়। পূজা উপলক্ষে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়, যা সুইজারল্যান্ডে বাঙালি সমাজের অবস্থানকে দৃশ্যমান করে তোলে।
প্রবাস জীবনের ব্যস্ততা ও একাকিত্বের মাঝেও দুর্গাপূজা বাঙালিদের একত্রিত করে। প্রতিমা আনা, মণ্ডপ সাজানো, অনুষ্ঠান আয়োজন—সবকিছুতেই থাকে সমবেত প্রচেষ্টা। এতে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য পারিবারিক বন্ধন, যা প্রবাসে থেকেও বাঙালিদের মনে করিয়ে দেয় বাংলার টান। সুইজারল্যান্ডে শীতল আবহাওয়ার মধ্যেও এই কয়েকটি দিন বাঙালিদের হৃদয়ে জ্বালিয়ে তোলে আনন্দের উষ্ণ প্রদীপ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সুইজারল্যান্ডে দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রতীক। এই পূজা তাদের মনে করিয়ে দেয় তারা ভৌগোলিকভাবে যত দূরেই থাকুক না কেন, শিকড় এখনো বাংলার মাটিতেই রয়ে গেছে। তাই দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক সেতুবন্ধন—যা ধর্মীয় ভক্তি, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও প্রবাস জীবনের ঐক্যকে এক সূত্রে গেঁথে রাখে।
ছবি: সংগৃহীত