পিয়া রায়
নরওয়েতে দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের জন্য কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমাবেশ। মূলত রাজধানী অসলো ও তার আশপাশের এলাকাগুলিকে কেন্দ্র করেই এই পূজার আয়োজন হয়। নরওয়েতে বসবাসরত ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা মিলে দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছেন বহু বছর ধরে। তাদের এই উদ্যোগকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে প্রবাস জীবনের এক উজ্জ্বল আবহ, যেখানে পূজা শুধু আধ্যাত্মিকতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রবাসী সমাজের মিলনমেলার রূপ ধারণ করেছে।
অসলোতে “Norwegian Puja Committee” এবং প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবছর দুর্গাপূজার আয়োজন করে থাকে। এখানে প্রতিমা সাধারণত কলকাতা থেকে আনা হয়, যদিও কখনও কখনও স্থানীয় কারিগররা ক্ষুদ্রাকৃতির প্রতিমা তৈরি করে থাকেন। পূজার দিনগুলিতে ভোর থেকে শুরু হয় অঞ্জলি, আরতি এবং পুষ্পাঞ্জলি। এরপর থাকে ভোগের আয়োজন, যা একেবারেই বাঙালিয়ানা স্বাদের প্রতিফলন। খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েসের মতো খাবার প্রবাসে থেকেও সবার মনে করিয়ে দেয় বাংলার দুর্গাপূজার দিনগুলির স্মৃতি।
দুর্গাপূজার অন্যতম বিশেষ দিক হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নরওয়েতে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালি শিশুরা গান, নাচ, আবৃত্তি ও নাটকের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিভা প্রকাশ করে। বড়রা তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করেন, কখনও কখনও ভারত ও বাংলাদেশের অতিথি শিল্পীরাও যোগ দেন। এসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়, যা তাদের শিকড়কে আঁকড়ে ধরতে সহায়তা করে।
এখানকার পূজা শুধু বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নরওয়েজিয়ান স্থানীয়রাও কৌতূহলবশত এই উৎসবে যোগ দেন। তারা প্রতিমা দর্শন করেন, অঞ্জলি দেন এবং ভোগের স্বাদ গ্রহণ করেন। এতে দুই সংস্কৃতির মধ্যে একটি আন্তরিক সেতুবন্ধন তৈরি হয়, যা প্রবাসী জীবনের অন্যতম সাফল্য। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমেও কখনও কখনও দুর্গাপূজা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা উৎসবটিকে আরও দৃশ্যমান করে তোলে।
আবহাওয়ার দিক থেকেও নরওয়ের দুর্গাপূজা বেশ বিশেষ। অক্টোবর মাসের ঠান্ডা দিনে পূজার উষ্ণ পরিবেশ সবার মনে নিয়ে আসে আনন্দের রঙ। অল্প সংখ্যক মানুষ হয়তো অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু আবেগের দিক থেকে এর ভরপুর উপস্থিতি বাঙালিদের জীবনে এক বিশাল তাৎপর্য বহন করে। পূজাকে ঘিরে সবাই মিলে তহবিল সংগ্রহ, মণ্ডপ সাজানো, প্রতিমা স্থাপন এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ ভাগাভাগি করে নেন। এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য পারিবারিক বন্ধন, যা প্রবাসে থেকেও সবাইকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে।
সব মিলিয়ে নরওয়ের দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটি কেবল দেবীর আরাধনা নয়, বরং শিকড়ের টান, সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। অসলো কিংবা অন্য যে শহরেই পূজা হোক না কেন, কয়েকটি দিন যেন পুরো দেশকে রাঙিয়ে তোলে বাঙালিয়ানার রঙে। শীতল আবহাওয়ার মধ্যেও দুর্গাপূজা নরওয়ের প্রবাসীদের মনে এক উষ্ণ আবেগ জাগিয়ে তোলে, যা তাদের নতুন দেশে থেকেও চিরন্তন বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।
ছবি: সংগৃহীত
