পিয়া রায়
আয়ারল্যান্ডে দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের জন্য কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক গভীর সাংস্কৃতিক আবেগের প্রকাশ। ইউরোপের এই দ্বীপদেশে ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও উৎসবের উচ্ছ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। মূলত রাজধানী ডাবলিনকে কেন্দ্র করেই দুর্গাপূজার আয়োজন হয়, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর্ক, গ্যালওয়ে ও লিমেরিকের মতো শহরেও প্রবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে পূজা করতে শুরু করেছেন। ডাবলিনের “Bengali Association of Ireland” এবং অন্যান্য প্রবাসী সংগঠন মিলেই এ উৎসবকে বড় আকারে উদযাপন করে।
দুর্গাপূজার দিনগুলোতে ডাবলিনের কোনো কমিউনিটি হল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম রূপ নেয় অস্থায়ী পূজামণ্ডপে। প্রতিমা সাধারণত কলকাতা থেকে বিশেষভাবে আনা হয়, আবার অনেক সময় স্থানীয় কারিগরদের হাতে তৈরি প্রতিমাও ব্যবহৃত হয়। পূজার আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য পুরোহিতকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, কখনও স্থানীয়ভাবে বসবাসরত পুরোহিতরা এই দায়িত্ব পালন করেন। মহাষষ্ঠী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই থাকে অঞ্জলি, সন্ধ্যারতি, ধুনুচি নাচ এবং ভোগ বিতরণ। ভোগে থাকে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি ও পায়েস, যা প্রবাসেও বাঙালির ঐতিহ্যকে অটুট রাখে।
আয়ারল্যান্ডের দুর্গাপূজার অন্যতম বড় আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রবাসী বাঙালি শিশু-কিশোরেরা বাংলা গান, নৃত্য, আবৃত্তি ও নাটকের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিভা উপস্থাপন করে। এতে তারা কেবল আনন্দই পায় না, বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের গভীর পরিচয় গড়ে ওঠে। প্রবাসের দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য এই পূজা এক প্রকার সাংস্কৃতিক শিক্ষালয়ের ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি কলকাতা বা ঢাকা থেকে আগত শিল্পীরাও বিশেষ পরিবেশনা নিয়ে আসেন, যা পূজার আবহকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আয়ারল্যান্ডের দুর্গাপূজায় কেবল ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরাই নয়, স্থানীয় আইরিশ নাগরিকরাও যোগ দেন। তারা প্রতিমা দর্শন করেন, আরতিতে অংশ নেন এবং ভোগের স্বাদ নেন। এতে দুই সংস্কৃতির মধ্যে একটি উষ্ণ সেতুবন্ধন তৈরি হয়। ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও গবেষক বাঙালিদের অবদানও পূজাকে প্রাণবন্ত করে তোলে, কারণ তাদের উপস্থিতিই আয়োজনকে বহুজাতিক মাত্রা দেয়। স্থানীয় মিডিয়াতেও কখনও কখনও দুর্গাপূজার কভারেজ দেখা যায়, যা প্রবাসে বাঙালির অবস্থানকে দৃশ্যমান করে।
অক্টোবরের শীতল আবহাওয়ার মধ্যেও দুর্গাপূজা আয়ারল্যান্ডের বাঙালিদের জন্য এক উষ্ণতার উৎস। পূজাকে কেন্দ্র করে সবাই মিলে তহবিল সংগ্রহ, প্রতিমা আনা, মণ্ডপ সাজানো এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ ভাগাভাগি করে নেন। এতে প্রবাসী জীবনের একাকিত্ব অনেকটাই দূর হয়, আর তৈরি হয় পারিবারিক বন্ধনের মতো এক উজ্জ্বল সম্প্রদায়। এভাবেই দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে আয়ারল্যান্ডে বাঙালির সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রতীক।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আয়ারল্যান্ডের দুর্গাপূজা প্রবাসী জীবনের শিকড়ের টান, ধর্মীয় ভক্তি এবং সাংস্কৃতিক চেতনার এক অসাধারণ সমন্বয়। এটি কেবল দেবীর আরাধনা নয়, বরং প্রবাসে থেকেও বাংলার গন্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম, যা আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত প্রতিটি বাঙালিকে গর্বিত করে এবং তাদের একসঙ্গে বেঁধে রাখে।
ছবি: সংগৃহীত