পিয়া রায়
স্পেনে দুর্গাপূজা আজ আর কেবল প্রবাসী বাঙালিদের জন্য একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে বহুসাংস্কৃতিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। ইউরোপের এই দেশটি ঐতিহাসিকভাবে শিল্প, সংস্কৃতি ও উৎসবের জন্য পরিচিত। এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা তাঁদের প্রিয় দুর্গোৎসবকে নতুন আবাসভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রধানত মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ভ্যালেন্সিয়া ও মালাগার মতো শহরগুলোতেই দুর্গাপূজার আয়োজন হয়। প্রতিটি আয়োজনের পেছনে থাকে স্থানীয় প্রবাসী সংগঠনগুলির নিরলস প্রচেষ্টা, যেমন Bengali Association of Spain বা ছোট আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক মঞ্চ, যারা অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিমা আনা, মণ্ডপ সাজানো এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নির্ধারণ পর্যন্ত সমস্ত কাজ সামলে নেন।
প্রতি বছর শরৎকালে যখন বাংলার আকাশে কাশফুল দোলে, তখনই স্পেনের এই শহরগুলোতে ভিনদেশি আবহাওয়ার মধ্যেও বাঙালির হৃদয়ে জেগে ওঠে উৎসবের সুর। কোনো কমিউনিটি হল বা ভাড়া করা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গড়ে ওঠে অস্থায়ী মণ্ডপ। অনেক সময় প্রতিমা কলকাতা থেকে বিশেষভাবে পাঠানো হয়, আবার কখনও স্থানীয় শিল্পীর তৈরি প্রতিমাও পূজায় ব্যবহৃত হয়। মহাষষ্ঠী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত অঞ্জলি, সন্ধ্যারতি, ধুনুচি নাচ, আর ভোগ বিতরণের মধ্যে দিয়ে পূজার দিনগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ভোগে থাকে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, মিষ্টি—যা প্রবাসেও বাঙালির ঐতিহ্যকে জিইয়ে রাখে।
স্পেনে দুর্গাপূজার আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাঙালি শিশুরা গান, নাচ ও আবৃত্তির মাধ্যমে নিজেদের প্রতিভা উপস্থাপন করে, আবার প্রাপ্তবয়স্করা নাটক ও কবিতাপাঠে অংশ নেন। মাঝে মাঝে কলকাতা কিংবা ঢাকা থেকে শিল্পীরাও আসেন বিশেষ পরিবেশনার জন্য। এই সাংস্কৃতিক কর্মসূচি কেবল আনন্দই দেয় না, বরং প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রাখার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, স্পেনের স্থানীয় নাগরিকরাও এই উৎসবে অংশ নেন। অনেক সময় তারা প্রতিমা দর্শন করেন, ধূপ-ধুনোর গন্ধে মণ্ডপে সময় কাটান এবং ভোগের স্বাদ গ্রহণ করেন। এতে করে বাঙালি ও স্প্যানিশ সংস্কৃতির মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ মেলবন্ধন তৈরি হয়। বহুসাংস্কৃতিক সমাজে এ ধরনের উৎসব অভিবাসী সম্প্রদায়ের পরিচয়কে দৃশ্যমান করে এবং তাদের মূলস্রোতের সঙ্গে যুক্ত করে।
প্রবাস জীবনে দুর্গাপূজা বাঙালিদের কাছে এক আত্মিক আশ্রয়স্থল। কাজের ব্যস্ততা, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা ও একাকিত্বের মাঝেও পূজা তাদের একত্রিত করে। প্রতিমা আনা থেকে শুরু করে মণ্ডপ সাজানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই থাকে সমবেত প্রচেষ্টা। এতে জন্ম নেয় পারিবারিক বন্ধনের মতো এক উষ্ণ সম্পর্ক, যা প্রবাসে থেকেও বাংলার গন্ধকে জীবন্ত রাখে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, স্পেনে দুর্গাপূজা কেবল দেবী আরাধনা নয়, এটি প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের ঘোষণাও বটে। এই উৎসব তাঁদের শেকড়ের টানকে মনে করিয়ে দেয়, আবার বহুসংস্কৃতির স্পেনে তাঁদের অবস্থানকে দৃঢ় করে তোলে। তাই স্পেনের দুর্গাপূজা আজ একদিকে ভক্তির প্রতীক, অন্যদিকে বাঙালির ঐক্য ও সাংস্কৃতিক গর্বের এক অমূল্য উৎস।
ছবি: সংগৃহীত

