পিয়া রায়
ডেনমার্কে দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এক বিশেষ আবেগের নাম। ইউরোপের এই উত্তরাঞ্চলীয় দেশে বাঙালি জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও তাদের উৎসাহ এবং আন্তরিকতায় দুর্গাপূজা এখানে এক ব্যতিক্রমী মাত্রা পেয়েছে। মূলত বাংলাদেশি এবং ভারতীয় বাঙালিদের যৌথ প্রচেষ্টায় ডেনমার্কের বিভিন্ন শহরে প্রতিবছর শরৎকালে দুর্গোৎসব পালিত হয়। রাজধানী কোপেনহেগেনই এর কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও পূজা কমিটি মিলিতভাবে পূজার আয়োজন করে। এছাড়াও আরহুস ও ওডেন্সের মতো শহরগুলোতেও ছোট আকারে পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
ডেনমার্কের দুর্গাপূজা আয়োজন অনেকাংশে নির্ভর করে প্রবাসী বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর। পূজার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়—প্রতিমা অর্ডার দেওয়া হয় কলকাতা বা ঢাকায়, যা বিশেষভাবে আনা হয় সমুদ্রপথে বা বিমানে। কখনও কখনও স্থানীয় শিল্পীরাও সহজ উপকরণ ব্যবহার করে প্রতিমা গড়েন। পূজার দিনগুলোতে মণ্ডপ সাজানো হয় রঙিন আলোকসজ্জা, শিল্পকর্ম এবং সাংস্কৃতিক প্রতীকে। ঢাকের শব্দ বা উলুধ্বনির ভিড় ডেনমার্কে না থাকলেও, পূজার প্রতিটি আচার এখানে যতটা সম্ভব প্রামাণ্যভাবে পালিত হয়।
প্রবাসী জীবনে ভোগ রান্না এক বড় আকর্ষণ। কোপেনহেগেনের দুর্গাপূজায় খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়, যা স্বেচ্ছাসেবীরা রান্না করেন। শুধু খাবার নয়, এই ভোগের মাধ্যমে এক ধরনের নস্টালজিয়ার ভাগাভাগি হয়—বাংলার স্বাদ ও স্মৃতি মিলেমিশে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করে। পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। প্রবাসী বাঙালি শিশুরা গান, নাচ, আবৃত্তি পরিবেশন করে, আর প্রাপ্তবয়স্করা নাটক বা সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করেন। এসব কার্যক্রম নতুন প্রজন্মকে তাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা প্রবাসী জীবনে অমূল্য সম্পদ।
ডেনমার্কের পূজা কেবল বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্থানীয় ড্যানিশরাও এ উৎসবে যোগ দেন এবং ভারতীয়-বাংলাদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। এতে দুই সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে, যা অভিবাসী সমাজকে ডেনমার্কের মূলধারার সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে যুক্ত করে। অনেক সময় দেখা যায়, সুইডেন বা নরওয়ে থেকে প্রবাসীরা এসে কোপেনহেগেনের পূজায় অংশ নেন, যা উৎসবটিকে আঞ্চলিক মিলনমেলায় রূপ দেয়।
কোভিড মহামারীর সময় সীমিত আকারে হলেও দুর্গাপূজা আয়োজন করা হয়েছিল অনলাইন সম্প্রচারের মাধ্যমে, যাতে প্রবাসীরা ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। মহামারীর পর আবারও সরাসরি পূজার আয়োজন শুরু হয়েছে, যা প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
সব মিলিয়ে ডেনমার্কে দুর্গাপূজা নিছক ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; বরং এটি বাঙালি সংস্কৃতির টিকে থাকার সংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের ছোট্ট বাঙালি সমাজ প্রতিবছর শরৎকালে দুর্গাপূজার মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে, আনন্দ ভাগাভাগি করে এবং নিজেদের শিকড়ের প্রতি গভীর টানকে জীবন্ত রাখে। শীতল আবহাওয়া আর ব্যস্ত জীবনের মাঝে এ কয়েকটি দিন প্রবাসী বাঙালিদের জন্য হয়ে ওঠে অনাবিল উষ্ণতা, আনন্দ ও মিলনের প্রতীক।
ছবি: সংগৃহীত
