পিয়া রায়
সুইডেনে দুর্গাপূজা প্রবাসী বাঙালিদের কাছে কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি তাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার এক জীবন্ত প্রতীক। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির মতো সুইডেনেও বাঙালি কমিউনিটির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়, তবে তাদের উৎসাহ এবং একাত্মতার টানে দুর্গাপূজা এখানে এক বিশেষ আবহ তৈরি করে। প্রতি বছর শরৎকালে যখন পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে উৎসবের ঢেউ ওঠে, তখন সুইডেনের স্টকহোম, গথেনবার্গ কিংবা হেলসিনবোর্গের মতো শহরগুলোও ভিন্ন মাত্রায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এখানকার দুর্গাপূজার আয়োজন করে মূলত বিভিন্ন প্রবাসী বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাদের মধ্যে ‘সংবন্ধ’ অন্যতম, যারা হেলসিনবোর্গ শহরে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছে।
সুইডেনে পূজার পরিবেশ ভারতে বা বাংলার মতো জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও এর আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যই মূল আকর্ষণ। প্রতিমা প্রায়শই কলকাতা বা ঢাকায় তৈরি হয়ে এখানে পৌঁছে যায়, আবার কখনও স্থানীয় শিল্পীদের হাতেও তৈরি হয় সহজ উপকরণ দিয়ে। শারদীয়ার সেই ঐতিহ্য বজায় রাখতে ঢাক, উলুধ্বনি, ধুনুচি নাচ—সবকিছুই থাকে, যদিও সীমিত পরিসরে। ভোগ রান্না হয় স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে, যেখানে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি আর পায়েসের গন্ধ মিশে যায় প্রবাসী জীবনের নস্টালজিয়ায়। পূজা মণ্ডপগুলো সাজানো হয় সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, ফোক আর্ট ও আলোকসজ্জার মাধ্যমে, যা স্থানীয় সুইডিশ নাগরিকদেরও আকর্ষণ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সুইডিশরাও এই উৎসবে যোগ দেন এবং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন, যা পারস্পরিক সংস্কৃতি বিনিময়ের এক দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত।
কোভিড মহামারীর সময় সুইডেনে দুর্গাপূজার আয়োজন সীমিত হলেও, তা কখনো পুরোপুরি থেমে যায়নি। ছোট পরিসরে হলেও দেবীর আরাধনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ভোগ বিতরণ অব্যাহত ছিল। মহামারীর পরে আবার বৃহত্তর আকারে পূজা ফিরেছে, এবং প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এক ধরনের নতুন উদ্দীপনা জন্ম দিয়েছে। পূজা এখানে কেবল ভক্তির জায়গা নয়, বরং সমাজে মেলবন্ধনের ক্ষেত্রও। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও, নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা পূজার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নতুনভাবে খুঁজে পায়। অনেকেই নাচ, গান, আবৃত্তি কিংবা নাটকের মাধ্যমে পূজাকে আরও রঙিন করে তোলে।
সুইডেনে দুর্গাপূজা তাই নিছক ধর্মীয় আচার নয়; বরং এটি অভিবাসী জীবনের মধ্যে শিকড়ের টানকে জীবিত রাখার এক শক্তিশালী সেতুবন্ধন। এই উৎসব প্রবাসী বাঙালিদের মনে করিয়ে দেয়, তারা পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন, মায়ের আগমন বার্তা তাদের কাছে অনিবার্য আনন্দ ও মিলনের বার্তাই নিয়ে আসে। শীতল সুইডিশ আবহাওয়ার মাঝেও শরতের দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে উষ্ণতার এক অনন্য কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে প্রবাসী বাঙালি হৃদয়ের আবেগ, ভক্তি আর আনন্দ মিলেমিশে তৈরি করে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
ছবি: সংগৃহীত