যোগমায়া আচার্য
রাখী পূর্ণিমা বা রক্ষা বন্ধন ভারতীয় সংস্কৃতির এক অনন্য উৎসব, যা ভাই-বোনের সম্পর্ককে নতুন করে বেঁধে দেয় ভালোবাসা, স্নেহ ও দায়িত্বের সুতোয়। এই উৎসবের শিকড় বহু প্রাচীন ইতিহাস ও কিংবদন্তির সঙ্গে জড়িত। একদিকে যেমন এটি পারিবারিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে মজবুত করে, অন্যদিকে তেমনি সমাজে পারস্পরিক সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা দেয়।
রাখী পূর্ণিমার মূল তাৎপর্য নিহিত আছে সেই প্রতিশ্রুতিতে, যেখানে ভাই বোনকে সুরক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকার করে, আর বোন ভাইয়ের দীর্ঘায়ু ও সুখের জন্য প্রার্থনা করে। যদিও আজকের দিনে এই উৎসব অনেকটাই সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, তবুও এর আবেগ ও অর্থ একইভাবে গভীর। শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, এমনকি সেনাদের হাতেও রাখী বেঁধে দেশপ্রেম ও মানবিক বন্ধনের প্রতীক হিসেবে এই দিনটি উদযাপিত হয়।
ইতিহাস বলছে, রাখী পূর্ণিমা প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সমাজে পালিত হয়ে আসছে। মহাভারতের গল্পে দ্রৌপদী যখন শ্রীকৃষ্ণের হাতে আঘাত পান, তখন তিনি নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। সেই মুহূর্তে কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দেন, জীবনে যখনই দরকার হবে, তিনি দ্রৌপদীর পাশে থাকবেন। পরবর্তীতে কুরুসভায় দ্রৌপদী বস্ত্রহরণের সময় কৃষ্ণ সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। এভাবেই এই বন্ধন শুধু রক্তের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পরস্পরের প্রতি সুরক্ষা ও দায়িত্ববোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।
ইতিহাসে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে—মুঘল সম্রাট হুমায়ুন ও মেওয়ারের রানি কর্ণাবতীর গল্প। কর্ণাবতী, বাহ্যিক শত্রুর আক্রমণের মুখে পড়ে, হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য। হুমায়ুন সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সেনাসহ এগিয়ে আসেন। যদিও যুদ্ধের পরিণতি কর্ণাবতীর পক্ষে যায়নি, তবুও এই গল্প প্রমাণ করে রাখীর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য।
আজকের দিনে রাখী পূর্ণিমা ভারতের পাশাপাশি নেপাল, মরিশাস এবং বিশ্বজুড়ে ভারতীয় প্রবাসীদের মধ্যেও পালিত হয়। উৎসবের আগের দিন থেকে বাজারে রাখীর রঙিন সমাহার শুরু হয়—সুন্দর ডিজাইনের রাখী, সজ্জাসামগ্রী, মিষ্টি এবং উপহার। বোনেরা ভোরে স্নান সেরে পূজা করে ভাইয়ের কবজিতে রাখী বাঁধে, আর ভাই বোনকে উপহার দেয়। এই বিনিময়ের মধ্যে থাকে আনন্দ, ভালোবাসা, আর প্রতিশ্রুতির গভীরতা।
আধুনিক সমাজে রাখীর অর্থ আরও বিস্তৃত হয়েছে। বহু বোন তাদের সেনা, পুলিশ, ডাক্তার, বা অন্যান্য সেবাপ্রদানকারী পেশাজীবীদের রাখী বেঁধে কৃতজ্ঞতা ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে উদযাপন করেন। এমনকি অনেক সামাজিক সংগঠন অনাথ শিশু বা বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের সঙ্গে রাখী পূর্ণিমা পালন করে একাত্মতার বার্তা ছড়ায়।
তবে উৎসবের সৌন্দর্য বজায় রাখতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়, বরং আন্তরিক সম্পর্ক ও প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। আজকের দ্রুত গতির জীবনে ভাই-বোনের সম্পর্ক অনেক সময় দূরত্বে হারিয়ে যায়, কিন্তু রাখী পূর্ণিমা সেই সম্পর্ককে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়—কেউ একজন আমাদের পাশে আছে, আমাদের সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছে।
রাখী পূর্ণিমা তাই কেবল একদিনের উৎসব নয়, এটি একটি অনুভূতি, একটি প্রতিশ্রুতি, যা সারা জীবনের জন্য অটুট থাকে। এই দিনে যে সুতো বাঁধা হয়, তা ভালোবাসা, ভরসা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দুই হৃদয়কে চিরকাল বেঁধে রাখে। তাই রাখী পূর্ণিমার আসল সৌন্দর্য সেই প্রতিশ্রুতিতেই—যা সময়, দূরত্ব, কিংবা পরিস্থিতির বাধা মানে না, বরং ক্রমেই আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।