ছন্দা আচার্য
১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক ঐতিহাসিক মোড়—গঠিত হয় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন বা Quit India Movement। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মুম্বাইয়ের গওয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ভারতবাসীকে আহ্বান জানান: “করো বা মরো” (Do or Die)। এ এক অগ্নিস্নান; যেখানে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী নিজেদের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এই আন্দোলনের জন্মলগ্নে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। ব্রিটিশ সরকার ভারতের জনগণের মতামত উপেক্ষা করে দেশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। বহুদিন ধরেই জাতীয় কংগ্রেস এবং জনগণের ক্ষোভ জমছিল। গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস দাবি করে, “ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করুক, ভারতবাসী নিজের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করবে।”
আন্দোলনের প্রারম্ভেই গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-সহ জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের নেতৃত্বকে দমন করা। কিন্তু তার পরেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের গ্রাম থেকে শহর, অলিগলি থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত।
বিদ্রোহের রূপ নেয় সহিংসতায়—রেললাইন উপড়ানো, সরকারি অফিসে অগ্নিসংযোগ, পোস্ট অফিসে হামলা। ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনা বাহিনীর দমনপীড়ন ছিল ভয়াবহ; হাজার হাজার মানুষ নিহত, লক্ষাধিক গ্রেপ্তার হন।
এই সময়েই কিছু মহীয়সী নারীর সাহসিকতা দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। অরুণা আসাফ আলী দিল্লির গওয়ালিয়া ট্যাঙ্কে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে অদম্য সাহসের পরিচয় দেন। মাতঙ্গিনী হাজরা দক্ষিণবঙ্গে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন, হাতে জাতীয় পতাকা ধরে রেখেই।
যদিও এই আন্দোলন অব্যবস্থাপনায় পরিণত হয় এবং পরিকল্পনার অভাবে চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি, তবে এর প্রতিধ্বনি ছিল সুদূরপ্রসারী। ভারতবাসীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বুঝতে পারে—এখন আর দমন করা সম্ভব নয়।
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা স্পষ্ট ইঙ্গিত পায়, ভারতের জনগণ আর বশ্যতা মেনে নেবে না। সেই চাপেই কয়েক বছরের মধ্যে তারা স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়।
আজ ৮ আগস্ট, Quit India Movement Day স্মরণ করে আমরা মাথা নত করি সেইসব অজস্র শহিদ, তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি, যাঁরা এই দেশের স্বাধীনতার মূল স্তম্ভ গড়েছিলেন।
Quit India Movement ছিল কেবল একটি আন্দোলন নয়—এ ছিল এক আত্মত্যাগময় যাত্রা, একটি জাতির মুক্তিচেতনার জাগরণ, এক রুদ্ধশ্বাস ইতিহাস।