নরেন্দ্রনাথ কুলে
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মশতবর্ষে পদার্পণ করলেন ১৫ আগস্ট । তাঁর স্মরণে কোন আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হয়নি । স্বাধীনতা দিবসের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের উদ্দীপনার মাঝে কবির জন্মশতবর্ষ শব্দহীন থাকাটাই স্বাভাবিক। এই স্বাধীনতা মানুষের শোষণহীন সমাজ দিতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক থাকতে পারে । কিন্তু কৃষক শ্রমিক আজও কি তাঁদের শ্রমের মূল্য পাচ্ছে ? এই প্রশ্নের উত্তর কি একেবারে অচেনা, অজানা ? চলমান সমাজে তা অচেনা নয় । কবির সময় আর এখনকার শোষণের চরিত্র এক নয় । কিন্তু সমাজে মানুষ যে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয় বা হচ্ছে তার উদাহরণ দিতে এখন আর খুঁজতে হয় না । এই বঞ্চিত মানুষদের জন্য কিশোর কবির কলম কথা বলেছে । শুধু তাই নয় কবি তদানীন্তন বামপন্থী আদর্শের সাথে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সাম্যবাদের সাথে কবিসত্তার একাত্ততার বিরল নিদর্শন বাংলা কাব্যজগতে তাঁর স্বল্প জীবনে তিনি রেখেছেন । যে কবি বামপন্থী কর্মী হিসেবে পরিচিত, তিনি এই স্বাধীনতার উৎসবের আলোয় অবহেলিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক । অথচ কবি মানুষের কথাই বলেছে বাস্তবের মাটিতে নেমে। কিন্তু কবির জন্মের অর্ধ শতবর্ষে এই বাংলার তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তর থেকে 'সুকান্ত মূল্যায়ন' নামে এক স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল । অথচ কবির জন্ম-শতবর্ষ এখনো সেভাবে আলোকিত হওয়ার সূচনা দেখা যায়নি ।
কবি সুকান্ত দেখেছেন এক শ্রেণীর লোভের যাঁতাকলে মানুষের বিপন্নতা। তখন যেন পৃথিবীর কৃপণতায় ভরা । কৃপণ পৃথিবী যেন লোভের অস্ত্র দিয়ে কেড়ে নেয় মানুষের অন্নবস্ত্র । এই লোভের কাছে এক বিশাল অংশ বিপন্ন হয়ে পড়ে । এই বিপন্নতায় লড়াই তাদের করতে হয়, করে যেতে হয় । কখন হয়তো তারা জেতে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে জিতে যায় ওই লোভীর দল । এই দল লোভে গড়ে তোলে তার দুর্গ,গম্বুজ ও প্রাসাদ । আর চারপাশে বুভুক্ষু দলের ভীড় । কবির ভাষায়- 'নগরে ও গ্রামে জমেছে ভীড়/ভগ্ননীড়----/ক্ষুধিত জনতা আজ নিবিড়' ।
এই অভাবী ক্ষুধিত জনতা বাঁচার লড়াই করে । কিন্তু তাদের এই লড়াইয়ের বিরুদ্ধে চলে লোভের লড়াই । সেই লড়াইয়ে হারতে হয় অভাবী মানুষদের । কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সময়কে যেভাবে তুলে ধরেছিলেন, তা আজকের সময়ে তার প্রতিফলন অন্য রূপে হলেও, তবু বলা যায় --
"সামান্য কয়েকজন লোভী
অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে
আর সাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে
ক্ষয়ে যাওয়ার দল
সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা
তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা
অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার"
এই সাপেদের লোভের বিষাক্ত বায়ু স্রোতে অভাবী মানুষের অবস্থার কথা কবি শুনিয়েছেন মহামানবদ্বারে । কবি সবাইকে আহ্বান করেছেন সকল ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে আসতে । কিন্তু সব ভেদাভেদ ভুলতে বললেও একটি ভেদাভেদ যে থেকেই যায় তা কবি না বলে পারেন নি । মজুতদারের লোভ বিপন্ন মানুষকে আরো বিপন্নতা ও অসহায়তার দিকে যে ঠেলে দেয় কবি তা বারে বারে বলেছেন । তাই মানুষ আর মজুতদার - এই ভেদ যুগ যুগ ধরে যে থাকবে কবি তা ব্যক্ত করেছেন ।
'তারপর বহু শত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার ।'
মানুষ আর মজুতদারের ভেদাভেদ যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ বিপন্ন থাকবে নানাভাবে । আজ মজুতদারের রূপ বদলে গেছে। তবু মানুষ বিপন্নতার মাঝে তাদের লোভহীন জীবনকে বয়ে নিয়ে যায় । শোষণের কথা বলা এই কবিকে আজকের শাসক স্মরণ করলেও তা কি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ হতে পারে ? এ প্রশ্ন কি অবান্তর !