যোগমায়া আচার্য
রক্ত, আমাদের জীবনের মূলস্রোত। কিন্তু সেই রক্ত যখন নিজের রূপ বদলে মৃত্যুর বার্তা বয়ে আনে, তখন সে হয়ে ওঠে এক নিরব ঘাতক। এমনই এক রহস্যময় ও যন্ত্রণাদায়ক অসুখ হলো সিকল সেল ডিজিজ বা সিকল সেল অ্যানিমিয়া। প্রতিবছর ১৯ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় World Sickle Cell Day—এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়াতে, আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতি গড়ে তুলতে এবং প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে ভাবনার দরজা খুলে দিতে।
সিকল সেল রোগ আসলে এক ধরনের বংশগত রক্তরোগ, যেখানে রক্তের লাল কণিকা (RBC) স্বাভাবিক গোলাকার না হয়ে অর্ধচন্দ্র বা 'সিকল' আকৃতির হয়ে যায়। এই অস্বাভাবিক আকৃতির কারণে রক্ত চলাচলে বাধা তৈরি হয়, অক্সিজেন পরিবহনে সমস্যা হয় এবং শরীরে ব্যথা, দুর্বলতা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি এমনকি অকালমৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণতি ঘটে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এই রোগ জন্মের সময় থেকেই শরীরে থেকে যায় এবং সারা জীবন আক্রান্তকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়।
==========
‘সাতসকাল’ ই-খবরের কাগজ আবার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। অনুগ্রহ করে ফেসবুক পেজটি লাইক করুন এবং ইনবক্সে আপনার মূল্যবান পরামর্শ ও মতামত জানান।
==========বিশ্বে প্রতি বছর লাখ লাখ শিশু সিকল সেল রোগ নিয়ে জন্ম নেয়, বিশেষত আফ্রিকা, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে এই রোগের প্রভাব বেশি। ভারতের নির্দিষ্ট কিছু জনজাতির মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়—যেমন ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটে। এই অঞ্চলগুলিতে সচেতনতার অভাব ও প্রাথমিক চিকিৎসার অপ্রতুলতা এই রোগকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সিকল সেল রোগের কোনও স্থায়ী চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, তবে নিয়মিত ও সঠিক চিকিৎসায় এর প্রভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ওষুধ, রক্ত সঞ্চালন, নিউট্রিশনাল যত্ন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা—এই সব কিছু মিলে একজন সিকল সেল রোগীর জীবন অনেকটা সুস্থ রাখা সম্ভব। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা। বিয়ের আগে জেনেটিক কাউন্সেলিং, নবজাতকের স্ক্রিনিং এবং স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যমে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
এই রোগ শুধু শারীরিক কষ্টই নয়, মানসিক ও সামাজিক চাপও সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার বা সমাজ আক্রান্তদের অবজ্ঞা করে, বৈষম্যের চোখে দেখে। এমনকি, বিবাহ বা চাকরি ক্ষেত্রেও তারা অসুবিধার সম্মুখীন হয়। তাই সিকল সেল রোগের বিরুদ্ধে শুধু চিকিৎসা নয়, সামাজিক সহানুভূতি এবং মানবিকতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
World Sickle Cell Day আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিটি রক্তকণিকার মধ্যেই আছে এক জীবনের গল্প, এক মানুষের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নগুলো যেন রোগের কাছে হার না মানে, সেই দায়িত্ব আমাদের সকলের। সচেতনতা, সহানুভূতি এবং বিজ্ঞানকে হাত ধরে এগিয়ে চললেই এই রোগের আঁধার ভেদ করে আলোয় পৌঁছানো সম্ভব। সিকল সেল শুধু এক অসুখ নয়—এটা এক নীরব যুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধে জয়ই হোক আজকের অঙ্গীকার।