বিয়ার ব্রাউন
যুদ্ধ মানেই গোলাগুলি, ধ্বংস, রক্তপাত—এই দৃশ্যগুলোই চোখে ভাসে। কিন্তু যুদ্ধের এমন এক ক্ষত আছে, যা অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর, নীরব অথচ গভীর—সেটি হলো সংঘাতজনিত যৌ*ন সহিংসতা। এই সহিংসতা শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, বরং মানবতা, মর্যাদা ও আত্মার ওপর চলা এক নিষ্ঠুর আঘাত। যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর শরীর যেন হয়ে ওঠে এক “যুদ্ধের অস্ত্র”—যাকে ব্যবহার করা হয় প্রতিপক্ষকে ভাঙার, দমন করার, লাঞ্ছিত করার কৌশল হিসেবে। এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিশ্ব আজ এক কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় ১৯ জুন, International Day for the Elimination of Sexual Violence in Conflict পালনের মাধ্যমে।
এই দিবসের সূচনা হয় ২০১৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাতে যৌ*ন সহিংসতা রোধ করা, ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো, এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু এই পথ সহজ নয়। কারণ, ইতিহাস বলছে—যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকে হাজার হাজার নারীর কান্না, যার কোনও দলিল থাকে না, কোনও বিচার হয় না, কোনও প্রতিকার আসে না। অথচ তাদের শরীর, মন, সম্মান সব কিছু তছনছ হয়ে যায়, আর সমাজ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, ইরাক কিংবা আফগানিস্তান—যেখানে যুদ্ধ, সেখানেই যৌ*ন সহিংসতা। কঙ্গোতে একসময় যৌ*ন সহিংসতার এতটাই ব্যাপকতা ছিল যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম একে "বিশ্বের ধর্ষণের রাজধানী" নামে অভিহিত করে। গণধর্ষণ, যৌ*ন দাসত্ব, গর্ভধারণের মাধ্যমে জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলা, শিশুদের যৌ*ন ক্রীতদাসে পরিণত করা—এইসব ঘটনার পেছনে থাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, বিদ্রোহী গোষ্ঠী, এমনকি কখনও কখনও জাতিসংঘ মিশনের সদস্যও।
==========
‘সাতসকাল’ ই-খবরের কাগজ আবার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। অনুগ্রহ করে ফেসবুক পেজটি লাইক করুন এবং ইনবক্সে আপনার মূল্যবান পরামর্শ ও মতামত জানান।
==========কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে—কেন যুদ্ধেই নারীর শরীর পরিণত হয় সবচেয়ে সহজ শিকার? কারণ, নারীর ওপর চালানো সহিংসতা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং তা গোটা পরিবার, সমাজ, এমনকি জাতিকে ভেঙে দিতে পারে। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হলে সে শুধু শারীরিক যন্ত্রণা বহন করে না, বহন করে সামাজিক লজ্জা, বিচ্ছিন্নতা, অপমান। বহুক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাও তাকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, যে কাজটি একজন অস্ত্রধারী কয়েক মিনিটে করে, তার প্রভাব বহন করতে হয় বহু প্রজন্ম ধরে।
অবাক করা বিষয় হলো, এই ভয়ঙ্কর অপরাধের অধিকাংশই থেকে যায় ধামাচাপা দেওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা নীরব থাকেন—কখনও ভয়ের কারণে, কখনও লজ্জায়, কখনও সমাজের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায়। আবার অনেক সময়, সংঘর্ষপরবর্তী পরিবেশেই থাকে না কোনও কার্যকর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আর ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে শুধু “যুদ্ধ জয়” বা “পরাজয়”—নারীর কান্না, যন্ত্রণার নাম লেখা থাকে না।
এই প্রেক্ষাপটে International Day for the Elimination of Sexual Violence in Conflict শুধুমাত্র একটি সচেতনতা দিবস নয়, বরং এটি বিশ্ব বিবেকের এক জাগরণ। এই দিনে আমরা স্মরণ করি সেইসব নারী, পুরুষ ও শিশুকে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যৌ*ন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, কিন্তু বিচার পাননি। আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেইসব বীরাকে, যারা সমাজের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে অন্যদের সাহস যুগিয়েছেন।
এই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শুধু মানবাধিকার সংস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের ওপর ভরসা করলেই হবে না। প্রয়োজন ঘরে ঘরে সচেতনতা, সমাজে সংবেদনশীলতা এবং সবচেয়ে বড় কথা—দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। যুদ্ধক্ষেত্রের নারী শরীরকে আর যেন যুদ্ধের টুল না বানানো হয়। কোনও মতাদর্শ, ধর্ম, জাতি কিংবা ভূখণ্ড জয়ের নামে যেন আর কোনও নারী ধর্ষণের শিকার না হয়।
আজকের বিশ্বে অনেক আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন আছে যা এই ধরনের অপরাধকে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু শুধুমাত্র আইন থাকলে হবে না, চাই তার বাস্তব প্রয়োগ। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতের কোনও সৈন্য বা কমান্ডার নারীর শরীরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে না পারে—এটিও তার যুদ্ধের অধিকার।
একইসঙ্গে চাই ভুক্তভোগীদের জন্য উপযুক্ত সহায়তা, চিকিৎসা, পরামর্শ এবং পুনর্বাসন। তাদের শুধু সহানুভূতির নয়, প্রয়োজন আত্মসম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার। তারা যেন জীবনের মূলস্রোতে ফিরতে পারেন, নিজের মতো করে বাঁচতে পারেন। যুদ্ধ শুধু ধ্বংস নয়, তার মধ্যে থেকেও যেন নতুন জীবনের সূচনা হয়—সেই আশাতেই এই দিবসের তাৎপর্য।
বিশ্বজুড়ে যখন যুদ্ধ ও সংঘর্ষ থামছে না, তখন এই দিবসটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, এটি কেবল অতীতকে মনে করিয়ে দেয় না, ভবিষ্যতের জন্যও আমাদের প্রস্তুত করে। প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি দেশ, প্রতিটি মানুষ যদি আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেয়—"আমি যৌ*ন সহিংসতার বিরুদ্ধে, আমি ন্যায়বিচারের পক্ষে", তাহলে হয়তো একদিন এমন এক পৃথিবী গড়া সম্ভব হবে, যেখানে যুদ্ধ হবে না, নারী অপমানিত হবে না, মানুষ মানুষকে হেয় করবে না।
শেষ কথাটি তাই—যুদ্ধ শেষ হয় অস্ত্র থামলে, কিন্তু যৌ*ন সহিংসতার ক্ষত থেকে যায় বহু প্রজন্ম। সেই ক্ষত সারাতে হলে দরকার সচেতনতা, সহানুভূতি আর বিচারের নিশ্চয়তা। International Day for the Elimination of Sexual Violence in Conflict আমাদের সেই পথে এগিয়ে যেতে শেখায়—একটি মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ এবং নারীবান্ধব পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে।
অনুবাদ: পিয়া রায়