সন্ন্যাসী কাউরী
গ্রামীণ চিকিৎসক, যাদের আমরা সাধারণত "কোয়াক ডাক্তার" বা
আরও সম্মানজনকভাবে "গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী" বলে থাকি। ভারতীয় স্বাস্থ্য
ব্যবস্থায় এক অনস্বীকার্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন এই
গ্ৰামীণ চিকিৎসকরা। আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা এবং ভৌগোলিক দূরত্বের
কারণে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রায়শই এই চিকিৎসকদের উপর নির্ভরশীল থাকে।
তাঁদের ভূমিকা কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং
তারা গ্রামীণ জনজীবনে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য
ব্যবস্থার প্রচারেও একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
বিভিন্ন
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ, যা প্রায় ৮০
শতাংশেরও বেশি মানুষ গ্রামীণ চিকিৎসকদের উপর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য
নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, আয়ূষ (আয়ুর্বেদ, যোগ ও
প্রাকৃতিক চিকিৎসা, ইউনানি, সিদ্ধা এবং হোমিওপ্যাথি) পদ্ধতির অধীনে
৭,৫১,৭৬৮ জন নথিভুক্ত চিকিৎসক রয়েছেন (এপ্রিল ২০২৫ এর তথ্য অনুযায়ী)।
এদের অনেকেই গ্রামীণ এলাকায় কাজ করেন।
ভারতের
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এমবিবিএস চিকিৎসকের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে । সেই ঘাটতি
পূরণে অনেকটা সহায়ক হয়ে উঠেছে গ্ৰামীণ চিকিৎসকরা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী,
ভারতে প্রতি ১,৫১১ জনের জন্য মাত্র একজন এমবিবিএস ডাক্তার রয়েছেন, যা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের (প্রতি ১০০০ জনে ১ জন) থেকে অনেক কম।
গ্রামীণ এলাকায় এই অনুপাত আরও খারাপ, যা গ্রামীণ চিকিৎসকদের গুরুত্ব
অপরিসীম । সূত্র অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২ লক্ষ ৯ হাজার নথিভুক্ত
"হাতুড়ে ডাক্তার" বা "গ্রামীণ চিকিৎসক" রয়েছেন। ২০১৬ সালে নাম নথিভুক্ত
করণের শেষ হয়। তারপরে অনেকেই গ্রামীন চিকিৎসক হিসেবে মানুষকে পরিষেবা
দেওয়ার কাজে যুক্ত হয়েছেন, সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ধরলে প্রায় ৩ লক্ষ
গ্রামীণ চিকিৎসক এখন পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করছেন।
এই সংখ্যা রাজ্যের প্রায় ৩৮ হাজার গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
সারাদেশের নিরিখে গ্রামীন চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৬৫ লক্ষ। গ্রামীণ
চিকিৎসকদের সাধারণত কোনো সরকার স্বীকৃত কোনো ডিগ্রি না থাকলেও অভিজ্ঞতা এবং
স্থানীয় জ্ঞানের ভিত্তিতে তাঁরা চিকিৎসা করে থাকেন।
ভারতের
বিস্তীর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সংখ্যা অত্যন্ত
সীমিত। যেখানে রয়েছে, সেখানেও অনেক সময় চিকিৎসক, নার্স, বা প্রয়োজনীয়
সরঞ্জামের অভাব দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে, গ্রামীণ চিকিৎসকরাই সাধারণ
জ্বর, সর্দি-কাশি, ছোটখাটো আঘাত, বা পেটের সমস্যার মতো রোগের প্রাথমিক
চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। তাঁরা স্থানীয় সহজলভ্য ঔষধপত্র এবং নিজেদের
অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে রোগীদের আরোগ্য লাভে সহায়তা করে থাকেন। অনেক
সময়, গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে তাঁরাই রোগীদের সরকারি হাসপাতাল বা
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসার
ব্যবস্থা করতে সাহায্য করে।
গ্রামীণ চিকিৎসকরা কেবল
রোগ নিরাময় নয়, বরং রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকেন। তারা
স্থানীয় ভাষায় এবং সহজবোধ্য উপায়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যবিধি,
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, এবং সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের
গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেন। উদাহরণস্বরূপ, জলবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য
বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবহার, মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য মশারির
ব্যবহার, বা টিকাকরণের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁরা গ্রামবাসীদের বোঝাতে সক্ষম
হন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা গ্রামীণ জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে
সহায়তা করে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক।
বর্তমান
সময়ে গ্রামীণ চিকিৎসকরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন। তারা
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করার ফলে
গ্রামবাসীদের সাথে তাদের এক গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই
ঘনিষ্ঠতা তাদের পক্ষে গ্রামবাসীদের ব্যক্তিগত সমস্যা এবং চিকিৎসার প্রয়োজন
সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করে। অনেক সময়, চিকিৎসা ব্যয়ের
সামর্থ্য না থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে তারা নমনীয়তা দেখান বা বিনামূল্যে
পরামর্শ দেন, যা তাদের প্রতি মানুষের নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে বা মহামারীর সময়, যখন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের
পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে, তখন গ্রামীণ চিকিৎসকরাই প্রথম মানুষের আস্থা অর্জন
করে চিকিৎসা করে থাকেন। সম্প্রতি করোনা আবহে এই গ্রামীন চিকিৎসকদের ভূমিকা
ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময় জেলাগুলোতে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালেই করোনা
রোগীদের চিকিৎসা করা হত। চিকিৎসার অপ্রতুলতা, রোগীর চাপ, ভৌগোলিক দূরত্ব,
সচেতনতার অভাব, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক নানাবিধ কারণে মানুষ যখন হাসপাতালে
পৌঁছতে পারেনি তখন খুব সহজেই তারা গ্রামীণ চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছেছেন। কোভিড
পরিস্থিতিতে বা তার পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ চিকিৎসকেরাই সামনের সারিতে থেকে
লক্ষ লক্ষ মানুষের চিকিৎসা করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তারা অনেকেই কোভিডে
আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। ভারতবর্ষের গ্রামীণ এলাকায়
ফী বছর বন্যার পরবর্তী সময়ে মানুষ ও পশুর নানা রকম রোগের প্রাদুর্ভাব
ঘটে। সেই সময় সরকারি পরিষেবার পাশাপাশি গ্রামীন চিকিৎসকরা একটি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার গ্ৰামীণ
চিকিৎসক চন্দন পাল। প্রাথমিক চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর হাত, যশ, খ্যাতি,
চিকিৎসা পদ্ধতি যথেষ্ট আস্থা অর্জন করেছে মানুষের মধ্যে। জেলা সীমান্তে
অবস্থান করায়, দুই মেদিনীপুর জেলার প্রায় ত্রিশটিরও বেশি গ্ৰামের মানুষকে
তিনি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করে থাকেন। চিকিৎসক চন্দন পাল বলেন,
গ্ৰামীণ এলাকার মানুষের মধ্যে জ্বর সর্দি-কাশি নানান উপসর্গ দেখা দিলে
প্রথমেই আমাদের কাছে আসেন। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে চিকিৎসা করে থাকি।
মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন আবার জটিল রোগের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিই।
চন্দন
পালের মতোই ধরণী দণ্ডপাট, নীলাশীষ পট্টনায়েক রবি সাঁতরা, মোহন সাঁতরা,
দেবাশীষ শাসমল, সন্দীপ মাজী, ডা. রবিউল আলম, ডা. প্রাণতোষ মাইতি, দিলীপ
পান, স্বপন পাল, রফিকুল ইসলাম, কাঞ্চন দত্ত, পঞ্চানন দাস, সুরজিৎ মহাপাত্র,
ভূতিপ্রসাদ বেরা প্রমুখ চিকিৎসক গ্ৰামীণ এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে
স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে চলেছেন।
গ্রামীণ চিকিৎসকদের
ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তাদের কিছু সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের
মুখোমুখি হতে হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল প্রশিক্ষণের অভাব এবং আধুনিক
চিকিৎসা পদ্ধতির জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকা অনেক গ্রামীণ চিকিৎসক প্রচলিত কিছু
পদ্ধতির উপর নির্ভর করে চিকিৎসা করেন যা সবসময় বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত
নয়। এছাড়া, ভুল চিকিৎসা বা অতিরিক্ত ঔষধ প্রয়োগের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে।
এই
চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকার এবং স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির উচিত গ্রামীণ
চিকিৎসকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করা। তাদের আধুনিক
চিকিৎসা পদ্ধতি, ঔষধের সঠিক ব্যবহার, এবং রেফারেল সিস্টেম সম্পর্কে জ্ঞান
প্রদান করা। একই সাথে, তাদের কাজের একটি আইনি স্বীকৃতি প্রদান করা এবং
তাদের দক্ষতা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট পরিসরে চিকিৎসা করার অনুমতি দেওয়া।
এটি একদিকে যেমন তাদের ভুল চিকিৎসার প্রবণতা কমাবে, তেমনই অন্যদিকে গ্রামীণ
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও সুসংগঠিত করবে। গ্রামীণ চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে
সরকারি ভাবে প্রশিক্ষণ, আইনি স্বীকৃতি এবং শংসাপত্র প্রদানের দাবি বারবার
উঠলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। গ্রামীণ চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন এ
নিয়ে ব্লক, জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের কাছে, জেলা প্রশাসনের কাছে
এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি সহকারে ডেপুটেশন দিলেও তাদের দাবি
পুরোপুরি পূরণ হয়নি।
গ্রামীণ
চিকিৎসক সমিতি, প্রগ্রেসিভ রুরাল মেডিকেল প্র্যাকটিশনার্স ওয়েলফেয়ার
অ্যাসোসিয়েশন, প্রগ্রেসিভ মেডিকেল প্র্যাকটিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ
ইন্ডিয়া, ভিলেজ হেলথ এ্যাসোসিয়েশন সহ বিভিন্ন সংগঠন তাদের পেশাগত দাবি
নিয়ে আন্দোলন করলেও তাদের সমস্ত দাবি পূরণ হয়নি। প্রগ্রেসিভ মেডিকেল
প্র্যাকটিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির
সম্পাদক ডা. রবিউল আলম বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি চিকিৎসা বিজ্ঞানের
সিলেবাস ভিত্তিক রেজিস্টার ডাক্তার দ্বারা সরকারিভাবে গ্রামীণ চিকিৎসকদের
প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং প্রশিক্ষণ শেষে শংসাপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করতে
হবে। তিনি আরো বলেন, ইনফরমাল হেলথকেয়ার প্রোভাইডার হিসেবে পঞ্চায়েত ও
ব্লক স্তরে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যুক্ত করে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য
পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোভিড পরিস্থিতির আগে মুখ্যমন্ত্রী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা মতো পশ্চিমবঙ্গে ২০১৭ সালে প্রাইমারি
হেলথকেয়ার প্রোভাইডার নামে ছয় মাসের একটি কোর্স চালু হলেও ২০১৯ সালে তা
বন্ধ হয়ে যায়। রবিউল আলম'দের দাবি কোর্সটি এক বছরের জন্য করতে হবে এবং এই
কোর্স করার সুযোগ সকল গ্রামীন চিকিৎসককে দিতে হবে। এই দাবি নিয়ে
স্বাস্থ্য ভবন, জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দপ্তর, ব্লক স্বাস্থ্য
আধিকারিকের দপ্তরে বারবার ডেপুটেশন দিলেও তা কার্যকর হয়নি বলে তিনি জানান।
গ্রামীণ
চিকিৎসকরা ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক অপরিহার্য অঙ্গ। তাঁদের অক্লান্ত
পরিশ্রম এবং গ্রামীণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন
রক্ষায় এবং স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপযুক্ত
প্রশিক্ষণ, স্বীকৃতি, এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে তাদের এই ভূমিকা আরও
শক্তিশালী করা সম্ভব, যা সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান গ্রামীণ ভারত নির্মাণে
সহায়ক হবে।